বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
অসম্ভব কথা
৩৯

পণ্ডিতের মতো মুখমণ্ডল চতুর্গুণ মণ্ডলাকার করিয়া বলে, “এক যে ছিল রাজা, তাহার নাম ছিল অজাতশত্রু।”

 পাঠক চোখ টিপিয়া জিজ্ঞাসা করে, “অজাতশত্রু? ভালো, কোন্ অজাতশত্রু বলল দেখি?”।

 লেখক অবিচলিত মুখভাব ধারণ করিয়া বলিয়া যায়, “অজাতশত্রু ছিল তিন জন। একজন খৃষ্টজন্মের তিন সহস্র বৎসর পূর্ব্বে জন্মগ্রহণ করিয়া দুই বৎসর আটমাস বয়ঃক্রম কালে মৃত্যুমুখে পতিত হন। দুঃখের বিষয়, তাঁহার জীবনের বিস্তারিত বিবরণ কোনো গ্রন্থেই পাওয়া যায়।” অবশেষে দ্বিতীয় অজাতশত্রু সম্বন্ধে দশজন ঐতিহাসিকের পশু বিভিন্ন মত সমালোচনা শেষ করিয়া যখন গ্রন্থের নায়ক তৃতীয় অজাতশত্রু পর্য্যন্ত আসিয়া পৌঁছায় তখন পাঠক বলিয়া উঠে, “ওরে বাস্‌রে, কী পাণ্ডিত্য! এক গল্প শুনিতে আসিয়া কত শিক্ষাই হইল! এ লোকটাকে আর অবিশ্বাস করা যাইতে পারে না! আচ্ছা লেখক মহাশয়, তার পরে কী হইল!”

 হায়রে হায়, মানুষ ঠকিতেই চায়, ঠকিতেই ভালোবাসে, অথচ পাছে কেহ নির্ব্বোধ মনে করে এ ভয়টুকুও ষোলো আনা আছে; এইজন্য প্রাণপণে সেয়ানা হইবার চেষ্টা করে। তাহার ফল হয় এই যে, সেই শেষকালটা ঠকে কিন্তু বিস্তর আড়ম্বর করিয়া ঠকে।

 ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, “প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়ো না, তাহা হইলে মিথ্যা জবাব শুনিতে হইবে না।” বালক সেটি বোঝে, সে কোনো প্রশ্ন করে না। এইজন্য রূপকথার সুন্দর মিথ্যাটুকু শিশুর মতো উলঙ্গ, সত্যের মত সরল, সদ্য-উৎসারিত উৎসের মতো স্বচ্ছ—আর এখনকার দিনের সুচতুর মুখস্‌পরা মিথ্যা। কোথাও যদি তিলমাত্র ছিদ্র থাকে অম্‌নি ভিতর হইতে সমস্ত ফাঁকি ধরা পড়ে, পাঠক বিমুখ হয়; লেখক পালাইবার পথ পায় না।