মার্চ ২০২১-এ বাংলাদেশে হিন্দু বিরোধী সহিংসতা
এক হিন্দু যুবক কর্তৃক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় ইসলামি পণ্ডিত মামুনুল হককে কটুক্তির অভিযোগে ১৭ মার্চ, ২০২১ খ্রিস্টাব্দে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের হবিবপুর নোয়াগাঁও গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটে।[১] মাইকে বেশ কিছু উগ্রপন্থী মুসলমানরা হামলা ঘোষণা দিয়ে হামলা চালায় এতে ৮৮টি বাড়িঘর এবং ৭/৮টি পারিবারিক মন্দির ভাংচুর এবং আসবাবপত্র তছনছ করা হয়েছে।[২] হামলা ও ভাংচুরে নেতৃত্বে ছিলেন দিরাই উপজেলার সরমঙ্গল ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নাচনী গ্রামের মেম্বার ও ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি শহীদুল ইসলাম স্বাধীন ও তার আরেক সহকারী পক্কন মিয়া।[৩] এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তদন্ত চলমান রয়েছে।[৩] তবে হামলার ঘটনায় কেউ কেউ হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশকে জড়িত বলেছেন।[৪]
প্রেক্ষাপট
[সম্পাদনা]১৫ মার্চ শাল্লার পার্শ্ববর্তী উপজেলা দিরাই উপজেলায় হেফাজতে ইসলাম আয়োজিত সম্মেলনে সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বক্তব্য দেন। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বিরোধিতাকারী হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করে তার সমালোচনা করে ফেইসবুকে একটি পোস্ট দেন স্থানীয় হিন্দু যুবক ঝুমন দাশ।[৫] ওই ঘটনাকে ধর্মীয় উসকানি আখ্যায়িত করে পার্শ্ববর্তী চার গ্রামের মানুষ ঝুমনের বিরুদ্ধে ১৬ মার্চ রাতে বিক্ষোভ মিছিল করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের নির্দেশে নোয়াগাঁও গ্রামের মানুষই রাতেই ওই যুবককে আটক করে।[৬] ১৭ মার্চ সকালে কাশিপুর গ্রামের মসজিদের মাইক থেকে[৭] নোয়াগাঁও গ্রামে গিয়ে হামলা চালানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। সবাইকে সে গ্রামে একত্র হয়ে যাওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া হয়। সে গ্রামের বাসিন্দারা হামলার ব্যাপারে আগাম আঁচ করতে পেরে ফোন করে পুলিশকে খবর দেয়। নোয়াগাঁও গ্রামের পাশের দাড়াইন নদের তীরে কয়েক হাজার লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে সকাল নয়টার দিকে জড়ো হয়। প্রশাসন, পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিরা বিক্ষুব্ধ জনতার একটি অংশকে শান্ত করার চেষ্টার সময়ে, অন্য অংশ গ্রামে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়ে যায়। হাজারো মানুষের আক্রমণে গ্রাম ছেড়ে আত্মগোপনে যায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। শাল্লা উপজেলার চেয়ারম্যানের বরাতে জানা যায় শতাধিক বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়। বিত্তশালীদের ঘরে লুটপাট বেশি করা হয়।[৮] পালিয়ে যেতে না পারায় ঝুমন দাসের স্ত্রী ও স্থানীয় ইউপি চেয়াম্যানের স্ত্রীকে ব্যাপক মারপিট করা হয়। ইউপি চেয়ারম্যানের স্ত্রী বাথরুমে ঢুকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে তাকে সেখান থেকে টেনে বের করে মারপিট করা হয়৷[৭] ভাঙচুর করা হয় অন্তত ৭টি মন্দির[৯] এবং প্রার্থনাঘরগুলোর বিগ্রহগুলো।[১০] একজন ভুক্তভোগীর তথ্যমতে ঝুমনকে গ্রেফতারের পর পুলিশ গ্রামবাসীকে আশ্বস্ত করেছিল, কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু পরদিনই এ ভাঙচুর চেয়ারম্যানের সামনেই সংগঠিত হয়।[১১]
গ্রেফতার ও তদন্ত
[সম্পাদনা]হামলার ৩৬ ঘণ্টা পর মামলা হয় বলে স্থানীয় পুলিশের বরাতে জানা গিয়েছে।[১২] নোয়াগাঁও গ্রামের একাধিক বাসিন্দার তথ্যমতে, তাঁদের গ্রামের পার্শ্ববর্তী বরাম হাওরের মধ্যে শাল্লা অংশে গোসাইর বিল ও নিত্যার দাইর নামে দুটি জলমহাল রয়েছে। এ দুটি বিল ওয়াক্ফ এস্টেট থেকে ইজারা এনে কিছু বছর ধরে মাছ আহরণ করছিল নাচনি গ্রামের বাসিন্দা স্থানীয় সরমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শহিদুল ইসলাম ওরফে স্বাধীন এবং তাঁর লোকজন। ইজারার নীতিমালার শর্ত না মেনে তাঁরা পাম্প দিয়ে পানি সেচে মাছ ধরে। এতে নোয়াগাঁওসহ আশপাশের গ্রামের কৃষকেরা বোরো আবাদে সেচসংকটে পড়তে থাকে। এমতাবস্থায় নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দারা শাল্লা থানায় শহিদুল ইসলাম এবং তাঁর সহযোগীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু এরপরও বিলে সেচ বন্ধ না হলে গত ২৫ জানুয়ারি পুলিশের সিলেট রেঞ্জের ডিআইজির কাছে আরেকটি অভিযোগ দেওয়া হয়। দিরাই উপজেলা প্রশাসন ওই দিনই গোসাইর জলমহাল থেকে দুটি সেচপাম্পসহ ফখর উদ্দিনকে আটক করে। পরে তাঁকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জব্দ করা দুটি সেচপাম্প নিলামে বিক্রি করা হয় ৩৫ হাজার টাকায়। এ নিয়ে শহিদুল ইসলাম ও তাঁর সঙ্গীরা নানাভাবে নোয়াগাঁও গ্রামের লোকজনের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে দায়ের করা মামলায় শহিদুল ইসলামকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে বলে পুলিশ নিশ্চিত করে।[৬] ২০ মার্চ শহিদুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীর মতে লুটপাটকারীদের অধিকাংশই শহিদুলের গ্রামের বাসিন্দা।[১২]
প্রতিক্রিয়া
[সম্পাদনা]১৮ মার্চ র্যাবের মহাপরিচালক শাল্লায় উপস্থিত হয়ে অপরাধীদেরকে উপযুক্ত সাজার আওতায় আনার আশ্বাস দেন।[১৩] বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, এবং বিভিন্ন সংস্থা গুলো এক যুক্ত বিবৃতিতে ধর্মান্ধদের হামলার নিন্দা ও ক্ষতিগ্রস্তদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবী জানান হয়। বিবৃতিতে প্রশ্ন তোলা হয়, প্রশাসনের নজরদারী থাকা সত্ত্বেও মসজিদের মাইক ব্যবহার করে কেমন করে উগ্রবাদী গোষ্ঠী একত্রিত হয়ে এরূপ মধ্যযুগীয় তাণ্ডব চালাতে পারল।[১৪] আরেকটি যুক্ত বিবৃতিতে ১০ জন বিশিষ্ট নাগরিক উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে বলেন, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিরোধ না করা গেলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্তরায় সৃষ্টি হবে।[১৫] বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ভাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ সভাপতি এ ধরনের ঘটনায় বামদলগুলো প্রতিবাদ করলেও আওয়ামী লীগ ও প্রশাসন কেন নীরব সে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের মধ্যে সাম্প্রদায়িক লোকজন প্রবেশ করেছে কিনা।[১৬] রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতিনিধিরা গ্রামে যান এবং এঘটনার জন্য আওয়ামীলীগকে দোষারোপ করেন এবং দুস্থ পরিবারকে অর্থসাহায্য প্রদান করেন।[১৭] বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ থেকে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়।[১৮]
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]- বাংলাদেশে ধর্মীয় নির্যাতন
- ২০২১-এ বাংলাদেশে মোদী-বিরোধী বিক্ষোভ
- ২০২১ বাংলাদেশে দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুর ও সহিংসতা
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "মামুনুল হককে নিয়ে কটূক্তির জেরে শাল্লায় বাড়িতে হামলা"। বাংলা ট্রিবিউন। ২০২১-০৩-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৩-২৯।
- ↑ "সুনামগঞ্জে হিন্দু গ্রামে হামলা-ভাংচুর-লুটের প্রধান আসামী আটক"। বিবিসি নিউজ বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৩-২৯।
- ↑ ক খ "শাল্লার ঘটনায় স্বাধীনসহ ২৯ জনের রিমান্ড শুরু, গ্রেফতার আরো ৪"। নয়া দিগন্ত। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৩-২৯।
- ↑ "এডিটার'স মেইলবক্স: রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন, হেফাজতের 'দোষ" আর ১৯৭১ নিয়ে প্রশ্ন"। বিবিসি বাংলা। ২০২১-০৩-২৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৩-২৯।
- ↑ ব্যুরো, সিলেট। "সুনামগঞ্জ শাল্লায় হামলার ঘটনায় ৩০ ঘণ্টার পর মামলা : কৌশতগত কারণে প্রকাশ করা হচ্ছে না আসামীর সংখ্যা ও পরিচয়"। দৈনিক ইনকিলাব। সংগ্রহের তারিখ ১৯ মার্চ ২০২১।
- ↑ ক খ রহমান, খলিল। "হামলা হতে পারে জেনেও ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২১ মার্চ ২০২১।
- ↑ ক খ "মাইকে ঘোষণা দিয়ে হামলা: নির্বিকার পুলিশ | DW | 18.03.2021"। DW.COM। সংগ্রহের তারিখ ২১ মার্চ ২০২১।
- ↑ "ফেসবুকে কটূক্তি, সুনামগঞ্জে মাওলানা মামুনুল হকের সমর্থকদের হামলা"। সমকাল। ২৭ অক্টোবর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ মার্চ ২০২১।
- ↑ "সুনামগঞ্জে হেফাজত-সমর্থকদের হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট"। ইত্তফাক। সংগ্রহের তারিখ ১৯ মার্চ ২০২১।
- ↑ প্রতিনিধি, সুনামগঞ্জ; ডটকম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর। "সুনামগঞ্জে হিন্দু বাড়িঘরে হামলার অভিযোগ হেফাজতের বিরুদ্ধে"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ১৯ মার্চ ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ মার্চ ২০২১।
- ↑ "সুনামগঞ্জে ২০ বাড়িতে মামুনুল হকের অনুসারীদের হামলা"। যুগান্তর। সংগ্রহের তারিখ ১৯ মার্চ ২০২১।
- ↑ ক খ "সুনামগঞ্জে হিন্দু গ্রামে হামলা-ভাংচুর-লুটের প্রধান আসামী আটক"। বিবিসি বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২১ মার্চ ২০২১।
- ↑ "সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন সহ্য করা হবে না :র্যাবের মহাপরিচালক"। m.dailyinqilab.com।
- ↑ "সুনামগঞ্জের শাল্লায় সাম্প্রদায়িক হামলার নিন্দা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি | কালের কণ্ঠ"। কালেরকণ্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ২০ মার্চ ২০২১।
- ↑ প্রতিবেদক, নিজস্ব। "শাল্লার মতো ঘটনা ঘটতে থাকলে বাংলাদেশ 'এগিয়ে যাবে না'"। প্রথম আলো।
- ↑ "'আওয়ামী লীগে কি সাম্প্রদায়িক লোকজন ঢুকে গেছে?', প্রশ্ন ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতির"। দ্য ডেইলি স্টার। ১৮ মার্চ ২০২১। সংগ্রহের তারিখ ২১ মার্চ ২০২১।
- ↑ প্রতিবেদক, নিজস্ব। "শাল্লায় বিএনপির প্রতিনিধিরা দুষলেন আ.লীগকে"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২১ মার্চ ২০২১।
- ↑ "শাল্লা হামলা-লুটপাটের প্রতিবাদে জগন্নাথপুরে মানববন্ধন"। banglanews24.com। সংগ্রহের তারিখ ২১ মার্চ ২০২১।