বিষয়বস্তুতে চলুন

স্বরলিপি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বাংলা আকারমাত্রিক স্বরলিপি

মাত্রা,ছন্দ ও বিভাগ অনুযায়ী তালি ও খালির সহযোগে লিপিবদ্ধ করাকে স্বরলিপি বলে । স্বরলিপি হল লিখিত চিহ্নের দ্বারা সাঙ্গীতিক স্বরকে লিপিবদ্ধ করার পদ্ধতি। বহু প্রাচীন সভ্যতায় বিভিন্ন প্রতীকের সাহায্যে সুর লিপিবদ্ধ করার প্রচলন থাকলেও তা আধুনিক স্বরলিপির মত স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। মধ্যযুগীয় ইউরোপে প্রথম স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বরলিপি লিখন পদ্ধতি গড়ে ওঠে এবং পরবর্তীকালে তা সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীতে গৃহীত হয়।

স্বরলিপি লিখন পদ্ধতি ৪ প্রকার:[]

  1. আকারমাত্রিক (সা রে গা মা পা ধা না র্সা, সা -া -া -া)
  2. দণ্ডমাত্রিক (স র গ ম প ধ ন র্স, স - - -)
  3. ভাতখণ্ডে পদ্ধতি
  4. বিষ্ণুদিগম্বর পদ্ধতি

আকারমাত্রিক স্বরলিপি

[সম্পাদনা]

ভারতে আকারমাত্রিক স্বরলিপি উদ্ভাবন করেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পরবর্তীকালে তার অনুজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই পদ্ধতির উন্নয়ন করেন। এই পদ্ধতির স্বরলিপিতে ‘আ’-কার (-া)-এর মত চিহ্ন ব্যবহার করে তালের মাত্রা চিহ্নিত করা হয় এবং এ কারণেই এই পদ্ধতির নাম আকারমাত্রিক। এই পদ্ধতিতে সাতটি শুদ্ধ স্বর এবং পাঁচটি বিকৃত স্বর মিলিয়ে মোট বারোটি স্বর লিখিত হয় আ-কার সহযোগে। স্বরগুলি লিখিত হয় এইভাবে,

সাংকেতিক নাম শাস্ত্রীয় নাম[] উৎপত্তি[]
সা ষড়্‌জ বা খরজ ময়ূরের ধ্বনি হতে
ঋা কোমল ঋষভ
রা ঋষভ বা রেখাব বৃষভের ডাক হতে
জ্ঞ কোমল গান্ধার
গা গান্ধার ছাগলের ডাক হতে
মা মধ্যম শৃগালের ডাক হতে
হ্মা তীব্র বা কড়ি মধ্যম
পা পঞ্চম কোকিলের ধ্বনি হতে
দা কোমল ধৈবত
ধা ধৈবত ঘোড়ার ডাক হতে
ণা কোমল নিষাদ
নি নিষাদ বা নিখাদ হাতির ডাক হতে

মন্দ্র সপ্তক বা উদারার স্বর চিহ্নিত করতে স্বরের নিচে হসন্ত (্)-এর মত চিহ্ন ব্যবহৃত হয় এবং তার সপ্তক বা তারার স্বর চিহ্নিত করতে স্বরের উপরে রেফ্ (র্‍)-এর মত চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। তিনটি সপ্তকে পৃথক ভাবে লিখিত ১২টি স্বর নিচে দেওয়া হল:

মন্দ্র সপ্তক (উদারা) সা্ ঋ্ রে্ জ্ঞ্ গা্ মা্ হ্ম্ পা্ দ্ ধা্ ণ্ নি্
মধ্য সপ্তক (মুদারা) সা রে জ্ঞ গা মা হ্ম পা ধা ণা নি
তার সপ্তক (তারা) র্সা র্ঋ র্রে র্জ্ঞ র্গা র্মা র্হ্ম র্পা র্দ র্ধা র্ণ র্নি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গান অর্থাৎ রবীন্দ্রসংগীত সহ অন্যান্য সমস্ত বাংলা গানে এই পদ্ধতিতে স্বরলিপি লিখিত হয়।

ভাতখণ্ডে স্বরলিপি

[সম্পাদনা]
মন্দ্র সপ্তক (উদারা) सा़ रे़॒ रे़ ग़॒ ग़ म़ मऺ़ प़ ध़॒ ध़ नि़॒ नि़
মধ্য সপ্তক (মুদারা) सा रे॒ रे ग॒ मऺ ध॒ नि॒ नि
তার সপ্তক (তারা) सां रें॒ रे़ं गं॒ ग़ म़ मऺं धं॒ ध़ निं॒ निं

পাশ্চাত্য স্বরলিপি পদ্ধতি

[সম্পাদনা]

পাশ্চাত্য দেশ গুলিতে মোট চার প্রকার স্বরলিপি পদ্ধতি প্রকাশিত ছিল,[] যথা:

  1. সোল্‌ফা পদ্ধতি (Solva Notation)
  2. ন্যুম্‌স্ পদ্ধতি (Neumes Notation)
  3. চীভ্ পদ্ধতি (Cheve Notation)
  4. স্টাফ পদ্ধতি (Staff Notation)

বর্তমানে ন্যুম্‌স্ স্বরলিপি পদ্ধতির উন্নততর সংস্করণ স্টাফ স্বরলিপি পদ্ধতি পাশ্চাত্য দেশসমূহে প্রচলিত।[] নীচে এই স্টাফ স্বরলিপি পদ্ধতি বিশেষত্বগুলিরই আলোচনা করা হলো:

  1. এই পদ্ধতিতে ৫টি সমান্তরাল রেখার মধ্যে বা উপরে স্তরগুলি লিখতে হয় এবং এগুলি সাজানো হয় সর্বনিম্ন লেখা থেকে ক্রমশঃ ঊর্ধ্বাভিমুখী-ভাবে। এই ৫টি সমান্তরাল রেখা কে বলা হয় staff।[] “The five lines and spaces between them by which the relative pitch of sound is fixed”। তবে প্রয়োজন মতো এই পাঁচটি লেখার উপরে বা নীচে আরও ছোট ছোট সমান্তরাল রেখা বসানো যেতে পারে এবং এই অতিরিক্ত রেখাগুলিকে বলা হয় লেজার লাইন (leger line)।[] “The effect of these leger lines is to add for the time additional lines to the staff.”
  2. স্বর উঁচু বা নীচু বোঝাতে হলে যে চিহ্নটি ব্যবহৃত হয় তাকে বলা হয় ক্লেফ্ (clef)।[] “To fix the alphabetical names of notes placed no a staff, a sign called a clef is used.” —ক্লেফ্ তিন প্রকার, যথা: ‘F’ ক্লেফ্, ‘C’ ক্লেফ্ এবং ‘G’ ক্লেফ্। ‘F’ ক্লেফ্-এর আর একটি নাম বাস ক্লেফ্ (bass clef)। কারণ মন্দ্র বা অতি মন্দ্র স্বরগুলি বোঝাতে হলে ‘F’ ক্লেফ্ ব্যবহার হয়। আবার তারার স্তরগুলি বোঝাতে হলে ‘G’ ক্লেফ্ ব্যবহার হয়, তাই একে ট্রেব্‌ল্ ক্লেফ্ (treble clef) বলা হয়।
  3. স্বরগুলি লেখা হয় ডিম্বাকৃতি চিহ্নের সাহায্যে এবং এই চিহ্নগুলির সামান্য হেরফের ঘটিয়ে বোঝানো হয় সেইগুলির স্থায়িত্ব। সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী অর্থাৎ পূর্ণ মাত্রাসম্পন্ন স্বরটিকে বলা হয় সেমিব্রিভ (semibreve)।[]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. শম্ভুনাথ ঘোষ (২০০৪)। সংগীতের ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড। ৯, শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট, কলকাতা: আদি নাথ ব্রাদার্স। পৃষ্ঠা ১০৩–১০৬। 
  2. মৃণাল দাশ গুপ্ত (২০১৩)। সহজ পদ্ধতির বাঁশী শিক্ষা। ৯৮ হাজারী লেইন, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ: অশোক ধর, গণেশ এন্ড কোং। পৃষ্ঠা ১২। 
  3. সম্ভুনাথ ঘোষ (আগস্ট ১৯৯২) [প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮/ভাদ্র ১৩৮৬]। "স্বরলিপি পদ্ধতি"। প্রশ্নোত্তরে নজরুলগীতি (সপ্তম সংস্করণ)। শ্যামাচরণ দে ষ্ট্রীট: আদি নাথ ব্রাদার্স। পৃষ্ঠা ৮০–৮৮।