মার্টেনসাইট
মার্টেনসাইট ইস্পাত এর ক্রিস্টাল কাঠামোর একটি খুব শক্ত রূপ। এটির নামকরণ করা হয়েছে জার্মান ধাতুকৌশলী অ্যাডলফ মার্টেনসের নামে। এই শব্দটি দ্বারা এমন ধরনের ক্রিস্টাল গঠনের উপমাও দেওয়া হয় যারা ব্যপনবিহীন রূপান্তর দ্বারা গঠিত হয়ে থাকে।
বৈশিষ্ট্য
[সম্পাদনা]কার্বন ইস্পাতে, লোহার অস্টেনাইট দশার দ্রুত শীতলীকরণের (কোয়েঞ্চিং) মাধ্যমে মার্টেনসাইট গঠিত হয়। এই শীতলীকরণ প্রক্রিয়া এতই দ্রুত গতিতে হয়ে থাকে যে কার্বন পরমাণুসমূহ ক্রিস্টাল কাঠামো থেকে ব্যাপিত হয়ে সিমেন্টাইটে (Fe3C) পরিণত হওয়ার মত যথেষ্ট সময় পায়না। অস্টেনাইট হল লোহার গামা-দশা (γ-Fe),যা লোহা এবং অন্যান্য সংকর ধাতুর একটি কঠিন দ্রবণ। কোয়েঞ্চিং এর ফলে, মুখ-কেন্দ্রিক ঘনাকার কাঠামোর অস্টেনাইট দশা রূপান্তরিত হয়ে অনেকখানি বিকৃত হয় ও দেহ-কেন্দ্রিক টেট্রাগোনাল কাঠামো আকারে পরিণত হয় যাকে মার্টেনসাইট বলা হয় যা কার্বন দ্বারা অতিপৃক্ত থাকে। এই পার্শ্ব বিকৃতির যার ফলে প্রচুর পরিমাণে স্থানচ্যুতির সৃষ্টি হয় যা একটি প্রাথমিক ইস্পাত শক্তিশালীকরণ পদ্ধতি। পার্লাইট ইস্পাতের সর্বোচ্চ কঠিনতা ব্রিনেল স্কেলে ৪০০ যেখানে মার্টেনসাইট ব্রিনেল স্কেলে ৭০০ পর্যন্ত যেতে পারে। [১]
যখন অস্টেনাইট দশা, মার্টেনসাইটের সূচনা তাপমাত্রা(Ms) এ পৌঁছায় তখন অস্টেনাইট অস্থিতিশীল হয়ে যায় এবং মার্টেনসাইট রূপান্তর বিক্রিয়া শুরু হয়। যখন একে দ্রুত শীতলীকরণ (কোয়েঞ্চিং) করা হয় তখন একটি ক্রমবর্ধমান শতকরা পরিমাণের অস্টেনাইট, মার্টেনসাইটে রূপান্তর হতে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত নিম্ন রূপান্তর তাপমাত্রা Mf এ পৌঁছায়, যেখানে এই রূপান্তর প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে।
Msতাপমাত্রার নিচে ব্যপন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায় এবং ফেরাইট-সিমেন্টাইট দশা গঠিত হতে পারেনা। Ms এর নিচের তাপমাত্রায় তাৎক্ষনিকভাবে বিভক্তিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহ-কেন্দ্রিক-টেট্রাগোনাল কাঠামো তে রূপান্তর ঘটে যেখানে কার্বন পরমাণু দ্রবীভূত থাকতে পারে। লোহার দেহ কেন্দ্রিক টেট্রাগোনাল কাঠামো তে কার্বনের কঠিন দ্রবণ দশা তথা মার্টেনসাইট দশা খুবি অস্থিতিশীল একটি দশা যা খুবই উচ্চ পীড়নে থাকে এবং আণুবীক্ষণ যন্ত্রে একে একগোছা সূচের মত দেখায়। [২]
একটি ইউটেকটয়েড ইস্পাতে (০.৭৮% কার্বন),৬-১০% এর মত অস্টেনাইট বাকি থাকে যাকে সংরক্ষিত অস্টেনাইট বলা হয়। ইস্পাতে কার্বনের শতকরা পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে সংরক্ষিত অস্টেনাইটের পরিমাণ বাড়তে থাকে। ০.৬% কার্বন ইস্পাতে খুব তুচ্ছ পরিমাণে সংরক্ষিত অস্টেনাইট থাকে যা ০.৯৫% কার্বন ইস্পাতে বেড়ে ১৩% সংরক্ষিত অস্টেনাইট হয় এবং ১.৪% কার্বন ইস্পাতে আরো বেড়ে ৩০%-৪৭% পর্যন্তও হয়ে থাকে। মার্টেনসাইট গঠিত হওয়ার জন্য খুবই দ্রুতগতির কোয়েঞ্চিং এর প্রয়োজন। পাতলা প্রস্থচ্ছেদের ইউটেকটয়েড কার্বন ইস্পাতের জন্য যদি ৭৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা থেকে কোয়েঞ্চিং শুরু করা হয় এবং ৪৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় শেষ করা হয়, তাহলে সম্পূর্ণ পার্লাইট বিহীন মার্টেনসাইট ও খুব সামান্য পরিমাণে সংরক্ষিত অস্টেনাইট গঠিত হওয়ার জন্য প্রক্রিয়াটি মাত্র ০.৭ সেকেন্ডের মধ্যে সম্পন্ন হতে হবে। [১]
যেসব ইস্পাতে ০-০.৬% কার্বন রয়েছে সেসব ইস্পাতে মার্টেনসাইট দশাটি ছিলকে বা ফলা আকারে দৃশ্যমান হয়। যেসব ইস্পাতে ১% এর চেয়ে বেশি পরিমাণে কার্বন রয়েছে সেখানে মার্টেনসাইট একটি ফলক বা প্লেটের মত কাঠামো তৈরি করে যাকে প্লেট মার্টেনসাইট বলা হয়। এই দুইটি শতকরা কার্বনের পরিমাণের মধ্যবর্তী ইস্পাতে মার্টেনসাইট কণার ভৌত রূপ উপর্যুক্ত দুইটি রূপের মিশ্রণ হয়ে থাকে। সংরক্ষিত অস্টেনাইটের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে মার্টেনসাইটের শক্তি কমতে থাকে। শীতলীকরণের হার যদি সংকট শীতলীকরণ হারের চেয়ে ধীরে হয় তাহলে কিছু পরিমাণে পার্লাইটও তৈরি হয়ে থাকে যা গ্রেইন সীমারেখায় বৃদ্ধি পেতে থাকে যতক্ষণ না Ms তাপমাত্রায় যাচ্ছে। এরপরে বাকি অস্টেনাইট দশা, ইস্পাতে শব্দের গতির অর্ধেক গতিতে মার্টেনসাইটে রূপান্তরিত হতে থাকে
কিছু নির্দিষ্ট ধরনের সংকর ইস্পাতে Ms তাপমাত্রার নিচে কোয়েঞ্চিং শুরু করে এবং পরবর্তীতে স্থায়ী বিকৃতি করে প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল ২০%-৪০% পর্যন্ত কমানোর মাধ্যমে মার্টেনসাইট দশা তৈরি করা হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে পরমাণুর স্থানচ্যুতি ঘটে এবং যার ঘনত্ব 1013 /সেমি2 পর্যন্ত হতে পারে। স্থানচ্যুতির সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অধঃক্ষেপের সাহায্যে স্থানচ্যুতিকে নির্দিষ্টভাবে ধরে রাখার মাধ্যমে খুবই শক্ত ও কঠিন ইস্পাত উৎপন্ন করা যায়। এই বৈশিষ্ট্যকে প্রায়ই অনমনীয় সিরামিক যেমন ইট্রিয়া স্ট্যাবিলাইজড জিরকনিয়া ও বিশেষ ইস্পাত যেমন TRIP ইস্পাত তৈরিতে কাজে লাগানো হয়। এভাবে মার্টেনসাইট কে তাপমাত্রা বা পীড়ন দ্বারা প্রবৃত্ত করা যায়।[৩]
মার্টেনসাইট দশার বৃদ্ধির জন্য খুব কম পরিমাণের তাপীয় সক্রিয়ন শক্তি প্রয়োজন কারণ এই প্রক্রিয়াটি একটি ব্যপনবিহীন রূপান্তর, যার ফলে পরমাণুসমূহের খুব সূক্ষ কিন্তু দ্রুত পুনর্বিন্যাস ঘটে এবং এটি এমনকি ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রায়ও সংঘটিত হতে পারে। মার্টেনসাইটের ঘনত্ব অস্টেনাইট অপেক্ষা কম থাকায় মার্টেনসাইট রূপান্তরের কারণে একটি বড় পরিমাণে আয়তনের পরিবর্তন ঘটে।[৪] এখানে আয়তনের পরিবর্তনের চেয়েও মোচড় বিকৃতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ যার পরিমাণ ০.২৬ পর্যন্তও হতে পারে এবং এটি মার্টেনসাইট ফলকের আকৃতি নির্ধারন করে।[৫]
মার্টেনসাইট দশাকে লোহা-কার্বন সাম্য ফেজ ডায়াগ্রামে দেখানো হয়না কারণ এটি একটি অস্থিতিশীল দশা। সুস্থিতি দশাগুলো ধীরগতির শীতলীকরণের মাধ্যমে গঠিত হয় যার কারণে ব্যপন প্রক্রিয়া সংঘটনের জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায় যেখানে মার্টেনসাইট সাধারণত দ্রুত গতির শীতলীকরণের মাধ্যমে গঠিত হয়। যেহেতু রাসায়নিক প্রক্রিয়া বা সাম্যাবস্থার অর্জন প্রকিয়া উচ্চ তাপমাত্রায় ত্বরান্বিত হয়, সেহেতু তাপ প্রয়োগে সহজেই মার্টেনসাইট দশা বিনষ্ট হয়। এই প্রক্রিয়াটিকে টেম্পারিং বলা হয়। কিছু সংকর ধাতুতে টাংস্টেনের মতো উপাদান যা সিমেন্টাইটের নিউক্লিয়েশনে বাধা দেয়, তাদের যুক্ত করে প্রভাবটি হ্রাস করা যায়। তবে প্রায়শই এই নিউক্লিয়েশন প্রক্রিয়ার কারণে ক্রিস্টালে পীড়ন কমে যায়। যেহেতু কোয়েঞ্চিং পদ্ধতি কে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, সেহেতু অনেক ইস্পাত কেই আগে কোয়েঞ্চ করে প্রইয়োজনের চেয়েও বেশি পরিমাণে মার্টেনসাইট দশায় পরিণত করা হয় এবং পরবর্তীতে টেম্পারিং করে এর পরিমাণ প্রয়োগের প্রয়োজনমত কমানো হয়। মার্টেনসাইটের সূঁচের মতো আণুবীক্ষণিক কাঠামোটির কারণে পদার্থে ভঙ্গুরতা আসে। খুব বেশি পরিমাণে মার্টেনসাইট ইস্পাত কে ভঙ্গুর করে তলে আবার খুব সামান্য পরিমাণে থাকলে তা ইস্পাতকে নরম করে তোলে।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]- ইউটেকটিক
- ইউটেকটয়েড
- ফেরাইট (লোহা)
- ম্যারাজিং ইস্পাত
- স্প্রিং ইস্পাত
- টুল ইস্পাত
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]
- ↑ ক খ Baumeister, Avallone, Baumeister (১৯৭৮)। "6"। Marks' Standard Handbook for Mechanical Engineers, 8th ed.। McGraw Hill। পৃষ্ঠা 17, 18। আইএসবিএন 9780070041233।
- ↑ ASW Kurny। Fundamentals of Phase Diagram and Transformations।
- ↑ Khan, Abdul Qadeer (মার্চ ১৯৭২) [1972], "3", The effect of morphology on the strength of copper-based martensites (জার্মান and ইংরেজি ভাষায়), 1 (1 সংস্করণ), Leuven, Belgium: A.Q. Khan, University of Leuven, Belgium, পৃষ্ঠা 300
- ↑ Ashby, Michael F.; David R. H. Jones (১৯৯২)। Engineering Materials 2 (with corrections সংস্করণ)। Pergamon Press। আইএসবিএন 0-08-032532-7।
- ↑ Bhadeshia, H. K. D. H. (২০০১)। Geometry of Crystals (with corrections সংস্করণ)। Institute of Materials। আইএসবিএন 0-904357-94-5।