মধ্যপ্রদেশের ইতিহাস
ভারতীয় রাজ্য মধ্যপ্রদেশের ইতিহাস-কে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রাচীন যুগে এই অঞ্চলটি যথাক্রমে নন্দ, মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীন ছিল।
মধ্য যুগে এই অঞ্চলটিতে দুটি রাজপুত রাজবংশের উত্থান হয়, যথাক্রমে পারমার রাজবংশ ও চান্দেলা রাজবংশ, যার মধ্যে শেষোক্ত রাজবংশের রাজত্বকালেই খাজুরাহের মন্দির গুলির নির্মাণ হয়। এই মধ্য যুগেই মালওয়া সুলতানী বংশও রাজত্ব করে। আধুনিক যুগে মধ্যপ্রদেশে মুঘল সাম্রাজ্য ও মারাঠা সাম্রাজ্য এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উত্থান হয়।
ব্রিটিশ ভারতের দেশীয় রাজ্য গুলির মধ্যে গোয়ালিয়র, ইন্দোর, ও ভোপাল আধুনিক মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত ছিল। বিংশ শতাব্দির মধ্যভাগ পর্যন্ত এখানে ব্রিটিশ শাসন চলেছিল, যা ১৯৪৭ এ ভারত স্বাধীন হওয়ায় শেষ হয়। আজকের মধ্যপ্রদেশ ১৯৫৬ সালে গঠন হয় ও ২০০০ সালে মধ্যপ্রদেশ থেকে কিছু অংশ নিয়ে ছত্তিশগড় গঠন হয়।
প্রাচীন ইতিহাস
[সম্পাদনা]ভীমবেটকার গুহাগুলি এখনকার মধ্যপ্রদেশে পুরা প্রস্তর যুগে মানুষের যে বসতি ছিল, সেই তথ্য প্রমাণ করে। [১] প্রস্তর যুগের নানা সরঞ্জাম নর্মদার অববাহিকার নানা স্থানে পাওয়া গেছে।[৩] গুহাচিত্র সমেত গুহা বসতিগুলি, যার সবথেকে প্রাচীনটির সময়কাল মনে করা হয় প্রায় ৩০,০০০ খৃ.পূ্., নানা জায়গায় আবিষ্কৃত হয়েছে।[৪] বর্তমান মধ্যপ্রদেশে মানুষের বসবাস শুরু হয়েছিল নর্মদা, চম্বল ও বেতোয়া এই নদীগুলির অববাহিকায়।[৫] মালওয়া সংস্কৃতির তাম্র যুগের অনেক নিদর্শন এরান, কায়াঠা, মহেশ্বর, নগদা ও নাভডাটোলি সমেত অন্যান্য জায়গাতে পাওয়া গেছে।[৩]
প্রথম বৈদিক যুগে, বিন্ধ্য পর্বতমালা ইন্দো-আর্য অঞ্চলের দক্ষিণ সীমান্ত চিহ্নিত করত। প্রাচীনতম সংস্কৃত সাহিত্য ঋগ্বেদে, নর্মদা নদীর উল্লেখ নেই। ৪র্থ খৃষ্টপূর্বে ব্যাকরণবিদ পাণিনি মধ্যভারতে অবন্তী জনপদের কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে নর্মদার দক্ষিণে শুধুমাত্র অশ্মক রাজ্যের উল্লেখ আছে।[৫] বৌদ্ধ গ্রন্থ অঙ্গুত্তরনিকায় যে ষোলোটি মহাজনপদের উল্লেখ আছে তার মধ্যে শুধুমাত্র অবন্তী,চেদি ও বৎস মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশ নিয়ে ছিল। মহাবস্তুতে দশহর্ন নামে একটি রাজত্বের উল্লেখ আছে যেটি মালবের দক্ষিণে ছিল। পালি ভাষায় লিখিত বিভিন্ন বৌদ্ধ রচনায় (উজ্জয়িনী), (বিদিশা), (মাহিষ্মতি) ইত্যাদি মধ্য ভারতের অনেক নগরের উল্লেখ পাওয়া যায়।[৬]
প্রাচীন গ্রন্থ অনুযায়ী, অবন্তী রাজ্যটিতে যথাক্রমে হৈহয় রাজবংশ, ভিতিহোরা রাজবংশ (হৈহয় রাজবংশের একটি শাখা) এবং প্রদ্যোত রাজবংশ রাজত্ব করেছে। প্রদ্যোত রাজবংশের শাসনকালে ভারতীয় উপমহাদেশে অবন্তী যথেষ্ট ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল।[৭] পরবর্তীকালে শিশুনাগ রাজবংশের রাজত্বকালে এটি মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। [৮] পরবর্তীকালে নন্দ সাম্রাজ্য শিশুনাগ রাজবংশকে উৎখাত করে, যারা আবার মৌর্য্য সাম্রাজ্য দ্বারা উৎপাটিত হয়। [৯]
মৌর্য এবং তার পরবর্তী শাসকগণ
[সম্পাদনা]খৃ.পূ. ৬ঠ শতাব্দিতে ভারতীয় নগরসভ্যতার যে জোয়ার দেখা দেয়, তাতে উজ্জয়িনী নগরী হয়ে ওঠে তার প্রধান কেন্দ্র এবং মালবে বা অবন্তী রাজ্যের প্রমূখ নগরী। এর আরও পূর্বদিকে ছিল বর্তমান বুন্দেলখন্ডে চেদি রাজ্যের অবস্থান। খৃ.পূ. ১৫ শতকে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য ভারতের উত্তরাংশকে সম্মিলিত করে মৌর্য্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন, যার মধ্যে বর্তমান মধ্যপ্রদেশের অনেকাংশই অন্তর্ভুক্ত ছিল। শোনা যায় রাজা অশোকের মহিষী ছিলেন বিদিশা নগরীর কন্যা—যেটি বর্তমান ভোপালের কাছে ছিল। সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পর মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় এবং খৃ.পূ. ৩য় থেকে ১ম শতকে, মধ্যভারতের অধিকার নিয়ে শক, কুষাণ ও স্থানীয় কিছু রাজবংশের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। খৃ.পূ. ১ম শতাব্দিতে, উজ্জয়িনী পশিম ভারতের প্রমূখ বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়, যেটি গঙ্গা অববাহিকার সমতলভূমি ও আরব সাগর উপকূলস্থ ভারতীয় নৌবন্দরের মধ্যবর্তী বাণিজ্যপথের মধ্যে ছিল। এই নগরী হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম চর্চার একটি কেন্দ্রও ছিল। দাক্ষিণাত্য মালভূমির উত্তরাংশে সাতবাহন সাম্রাজ্য ও পশ্চিম সত্রাপের শক সাম্রাজ্য মধ্যপ্রদেশের অধিকার পাওয়ার জন্য ১ম থেকে ৩য় খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত যুদ্ধে নিরত ছিল।
খৃষ্টীয় ২য় শতকে দাক্ষিণাত্যের সাতবাহন সাম্রাজ্যের রাজা গৌতমীপুত্র সাতকর্ণি যুদ্ধে শকদের প্রবলভাবে পরাজিত করে মালবের ও গুজরাটের কিছু অংশ জয় করেন।[১০]
৪র্থ ও ৫ম শতাব্দিতে ভারতের উওরাংশে গুপ্ত সাম্রাজ্য শাসন প্রতিষ্ঠা করে যা ভারতের "স্বর্ণ যুগ" হিসাবে চিহ্নিত। পরিব্রাজক ও উচ্ছকল্প বংশরা মধ্যপ্রদেশে ওই সময়ে শাসন করেছেন যারা গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে সামন্ত রাজা ছিলেন। ৫ম শতাব্দির শেষ দিকে, গুপ্ত সাম্রাজ্যের দক্ষিণ দিকের প্রতিবেশি, বাকাটক রাজবংশ দাক্ষিণাত্যের উত্তরাংশের শাষক ছিল যারা আরব সাগর ও বাংলার মধ্যবর্তী দাক্ষিণাত্যের মালভূমি অঞ্চল শাসন করত। এই সব রাজত্বই ৫ম শতাব্দির শেষভাগে অবলুপ্ত হয়।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ Centre, UNESCO World Heritage। "Rock Shelters of Bhimbetka"। UNESCO World Heritage Centre (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০২-১৬।
- ↑ Centre, UNESCO World Heritage। "Buddhist Monuments at Sanchi"। UNESCO World Heritage Centre (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০২-১৬।
- ↑ ক খ Pranab Kumar Bhattacharyya 1977, পৃ. 1।
- ↑ Pranab Kumar Bhattacharyya 1977, পৃ. 2।
- ↑ ক খ Pranab Kumar Bhattacharyya 1977, পৃ. 3।
- ↑ Pranab Kumar Bhattacharyya 1977, পৃ. 4-5।
- ↑ Pranab Kumar Bhattacharyya 1977, পৃ. 5।
- ↑ Pranab Kumar Bhattacharyya 1977, পৃ. 6।
- ↑ Pranab Kumar Bhattacharyya 1977, পৃ. 6-8।
- ↑ Ramesh Chandra Majumdar. Ancient India, p. 134
গ্রন্থপঞ্জি
[সম্পাদনা]- প্রণব কুমার ভট্টাচার্য (১৯৭৭)। হিস্টরিকাল জিওগ্রাফি অফ মধ্যপ্রদেশ ফ্রম আর্লি রেকর্ডস। মোতিলাল বানারসিদাস। আইএসবিএন 978-0-8426-9091-1।