বৃহদ্ভাগবতামৃত
বৃহদ-ভাগবতামৃত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের হিন্দুঐতিহ্যের অনুসারীদের একটি ধর্মীয় গ্রন্থ। হরি-ভক্তি-বিলাসের পাশাপাশি, এটি বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্ববিদ সনাতন গোস্বামীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রচনা।হরি-ভক্তি-বিলাসে বৈষ্ণব আচরণ ও আচার-অনুষ্ঠানের জন্য নির্দেশিকা নির্ধারণ করা হয়েছে,এবং বৃহদ্ভাগবতামৃতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষাকে সত্ত্বাতাত্ত্বিক ও আধ্যাত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বিষয়বস্তু
[সম্পাদনা]শ্রীবৃহদ্ভাগবতামৃত দুটি ভাগে বিভক্ত: পূর্ব-খণ্ড, বা প্রথম ভাগ, এবং উত্তর-খণ্ড বা শেষ ভাগ। প্রথম খণ্ডটির নাম শ্রীভগবৎ-কৃপা-সার-নির্ধারণ খণ্ড –অর্থাৎ পরমেশ্বর ভগবানের করুণার সারমর্ম নির্ণয়। দ্বিতীয় খণ্ড শ্রীগোলোকমাহাত্ম্য- নিরুপণ খন্ড পরিচিত -অর্থাৎ শ্রীগোলোকের মাহাত্ম্য নিরূপণ।
বৃহদ্ভাগবতামৃতের প্রথম ভাগে সনাতন গোস্বামী পরীক্ষিৎ ও তাঁর মাতা উত্তরার মধ্যকার একটি কথোপকথন বর্ণনা করেছেন। এটি ঘটেছিল পরীক্ষিতের শুকের কাছ থেকে ভাগবত পুরাণ পুরাণ শোনার পর। উত্তরা তার পুত্রকে ভাগবত পুরাণের সারমর্ম ব্যাখ্যা করতে বলেন এবং পরীক্ষিত তার কাছে গোপনীয় ভক্তির পর্যায়গুলি প্রকাশ করেন। নারদ কীভাবে কৃষ্ণের সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্ত খুঁজছিলেন সে সম্পর্কে পরীক্ষিৎ তার মাতাকে একটি গল্প বলেন।দেবর্ষি কৃষ্ণের ভক্তদের প্রতি তাঁর অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন যাদের ভক্তি কর্ম ও জ্ঞানমিশ্রা (ব্রহ্মা ও শিব) , তারপর নারদ শান্ত-রস (প্রহ্লাদ), দাস্য-রস (হনুমান), সখ্য-রস (অর্জুন), অবশেষে কৃষ্ণের সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্ত - উদ্ধবের কাছে এসেছিলেন, যিনি সর্বদা বৃন্দাবনে বাস করতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্লেষণ করছিলেন,কৃষ্ণের প্রতি গোপীদের প্রেম-ই ভক্তির সর্বোচ্চ স্তর।
বৃহদ্ভাগবতামৃতের দ্বিতীয় অংশে চিন্ময় আবাস গোলোকের মাহাত্ম্য ও আনন্দের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সেইসাথে জড় জগৎ পরিত্যাগের প্রক্রিয়া, প্রকৃত জ্ঞান, ভক্তি যোগ, শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেম ও জীবনের উচ্চ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে।দ্বিতীয় অংশে রয়েছে বনে এক বিচরণকারী রাখাল বালক এক বৃন্দাবনবাসির কাছ থেকে একটি মন্ত্র পেয়েছিলেন, এক গ্রহমণ্ডল থেকে অন্য গ্রহে ভ্রমণ করেছিলেন ও জীবের চেতনার বিভিন্ন স্তর অন্বেষণ করেছিলেন। তাঁর উচ্চলোকের এক আধ্যাত্বিক গ্রহ থেকে অন্য আধ্যাত্মিক গ্রহ যেমন, বৈকুণ্ঠ, ব্রহ্মলোক, শিবলোক তথা স্বর্গীয় গ্রহগুলিতে ভ্রমণক্রিয়া,সেই সেই লোক সমূহ সম্পর্কে বিবরণ প্রদান করেছে। [১]
দ্বিতীয় অংশে [২] চারটি অধ্যায় রয়েছে:
(১) বৈরাগ্য -ত্যাগ (২) জ্ঞান –আধ্যাত্বিক জ্ঞান(৩) ভজন – ভক্তিমূলক সেবা (৪) বৈকুণ্ঠ – আধ্যাত্মিক জগৎ। এই শাস্ত্রের দুটি অংশের প্রতিটির একটি পৃথক ইতিহাস রয়েছে। আমাদের পূজনীয় লেখক সনাতন গোস্বামী শুধু দুটি ইতিহাস লেখেননি। বরং, ঐশ্বরিক দম্পতি, শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের উপাসনার সুবিধার্থে, তিনি তাদের প্রভুত্বের মৌলিক বাস্তবতা ও প্রকৃতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।
শ্রীমদ্ভাগবত হল সমস্ত ধর্মগ্রন্থ যেমন বেদ, বেদান্ত, পুরাণ, ইতিহাস ইত্যাদির সারাংশ। সেই সারমর্ম মন্থন করে, এই গ্রন্থটি যথার্থভাবে শ্রীবৃহদ্ভাগবতামৃত -তথা ভাগবতের অপরিহার্য অমৃত - প্রকাশিত হয়েছে। এই বই জুড়ে, ভগবানের ভক্তিমূলক সেবা সম্পর্কিত সমস্ত বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছে। শ্রীজৈমিনি ও জনমেজয়ের মাধ্যমে বইটির মূল বক্তৃতাটি শ্রী পরীক্ষিত ও উত্তরার মধ্যে একটি কথোপকথনের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। শ্রীপরীক্ষিত শ্রীশুকদেব গোস্বামীর ঠোঁট থেকে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণের পরে, ও তক্ষক নাগ আসার পূর্বে, পরীক্ষিতের মাতা শ্রীউত্তরা দেবী তাকে বলেন, ",হে আমার প্রিয় পুত্র দয়া করে সহজ বোধগম্য ভাষায়, তুমি শ্রীশুকদেব গোস্বামীর কাছ থেকে যা শুনেছ তার সারমর্ম আমাকে বলো।" শ্রীবৃহদ্ভাগবতামৃত এই জিজ্ঞাসার সাথে শুরু হয়।
দ্বিতীয় অংশে, লেখক শ্রীশালগ্রাম ভগবান থেকে শুরু করে শ্রীনন্দ মহারাজের প্রিয় পুত্র শ্রীনন্দনন্দন পর্যন্ত পরমেশ্বর ভগবানের সমস্ত প্রকাশ ও অবতারগণের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। এই খণ্ডটি গোপ-কুমারের ইতিহাস দিয়ে শুরু হয়েছে। গোপ-কুমার তাঁর গুরুদেবের কাছ থেকে গোপাল-মন্ত্র গ্রহণ করেন। এই গোপাল-মন্ত্রের প্রভাবে তাঁর পক্ষে নির্বিঘ্নে সমস্ত গ্রহলোকে ভ্রমণ করা সম্ভব হয়। প্রথমত, তিনি ভগবানের অপ্রাকৃত প্রকাশের দর্শন পান যা এই পার্থিব জগত বা ভু-মন্ডলে আবির্ভূত হয়েছে, যেমন শ্রীশালগ্রাম ভগবান; রাজার প্রাসাদে বিরাজমান ভগবদ্ বিগ্রহের প্রকাশ; এবং পুরীর প্রাচীন দেবতা শ্রীজগন্নাথদেব। তিনি ক্রমানুসারে তাদের ক্রমবর্ধমান মাহাত্ম্য বর্ণনা করেন। তারপর তিনি মন্ত্র জপের প্রভাবে, তিনি স্বর্গ, মহ, জন, তপ ও ব্রহ্মলোকে পৌঁছে যান। সেখানে তিনি একের পর এক ভগবানের আরাধনামূলক প্রকাশের দিব্য দর্শন লাভ করেন যা সেই আবাসগুলিতে প্রকাশিত হয়েছিল। এভাবে তিনি ধারাবাহিকভাবে তাদের অতীন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠত্বও অনুভব করেন। তথাপি, গোপকুমার ঐসব স্থানে সম্পূর্ণ সুখ অনুভব করেন নি।
অতঃপর, তিনি ভগবানের অপর প্রকাশের দর্শন লাভ করেন যা ব্রহ্মাণ্ডের অষ্ট আবরণে বিদ্যমান ও মুক্তিলোকে বিরাজমান আছেন। মুক্তিলোকে, মুক্তির রাজ্যে গোপকুমার পরম পুরুষোত্তম ভগবানের তেজের প্রকাশ দেখেন, কিন্তু তবুও সম্পূর্ণ তৃপ্তি পান না। এরপরে, কৃতজ্ঞতার নীতি অনুসারে, তিনি পবিত্র নাম সংকীর্তন করেন, যা ভক্তির নয়টি প্রক্রিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। নাম-সংকীর্তনের শক্তিতে, তিনি প্রথমে বৈকুণ্ঠ, তারপর অযোধ্যা ও তদনন্তর দ্বারকা-পুরীতে ভ্রমণ করেন। যাইহোক, যেহেতু ঐসব চিন্ময় আবাসগুলোতে ভগবানের ঐশ্বর্যময়রূপের আধিক্য, বা ভগবানের প্রতি ভক্তি ভীতি ও শ্রদ্ধাবিশিষ্ট, তাই তিনি সেখানে পরমেশ্বর ভগবানের উপাসনামূলক প্রকাশের সাথে স্বতঃস্ফূর্ত হৃদয়ে যুক্ত হতে পারেন নি।
পরিশেষে, গোপকুমার পৃথিবীতে গোলোকের প্রকাশ ভৌম ব্রজ বৃন্দাবনে ফিরে আসেন। এখানে তিনি রাগানুগা ভক্তি বা স্বতঃস্ফূর্ত ভক্তিমূলক সেবা সম্পাদন করেন যা ব্রজের নিত্য পরিকরদের বৈশিষ্ট্য। রাগানুগা ভক্তি অনুশীলনের ফলস্বরূপ তিনি গোলোক-বৃন্দাবন লাভ করেন। সেখানে, তিনি তার ঈপ্সিত লক্ষ্য - ব্রজরাজপুত্র শ্রীকৃষ্ণের সেবা লাভ করেন।
এই ইতিহাস থেকে এই উপসংহারে আসা উচিত নয় যে, ভগবানের বিভিন্ন প্রকাশের তত্ত্ব বা মৌলিক সত্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে। শ্রী শালগ্রাম ভগবান থেকে শ্রীনন্দনন্দন (নন্দ মহারাজের প্রিয় পুত্র শ্রীকৃষ্ণ) পর্যন্ত ভগবানের সমস্ত প্রকাশ সম্পূর্ণ। তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে, তারা এক, তবুও রসের দৃষ্টিকোণ থেকে, বা চিন্ময় সম্পর্কের মাধুর্য্যের আধিক্যবশত শ্রী নন্দনন্দন সর্বোত্তম।
বৃহদ্ভাগবতামৃতে কৃষ্ণের বিভিন্ন শ্রেণির ভক্তদের বর্ণনা রয়েছে, যেমন: ঘনিষ্ঠ ভক্ত ও নিকটতম ভক্তদের ভক্ত।ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ চৈতন্যচরিতামৃতে (আদি লীলা, ৫/২০৩) তার তাৎপর্য্যে লিখেছেন , যদি কেউ ভক্তদের সম্পর্কে তথা কৃষ্ণের ভক্তিমূলক সেবা সম্পর্কে জানতে চান, তার বৃহদ্ভাগবতামৃত পাঠ করা উচিত।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Brhad-bhagavatamrta"। www.purebhakti.com (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৮-০৩-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৩-১৯।
- ↑ Śrī Brhat Bhāgavatāmta Second Canto by Sri Srimad Bhakti vedānta Narayana Gosvāmi Mahārāja
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- Sanātana Gosvāmī; Bhānu Swami (২০১৮), Śrī Bṛhad-bhāgavatāmṛta. Includes English translation of the original text, and a full-translation of the Dig-darśinī commentary. (3 volumes)
- Garg, Gaṅgā Rām (১৯৮২), An Encyclopedia of Indian Literature, Mittal Publishers, আইএসবিএন 9780391027794
- Sanatana Goswami; Gopiparanadhana Dasa (২০০২), Śrī Bṛhad-bhagavatāmrta. Includes the Devanagari text, a roman transliteration, word-for-word meanings, English translation, দিকদর্শনী টীকার সারমর্মসহ. (৩ ভলিউম), ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্ট, আইএসবিএন 0-89213-348-1