বীরশিলা
বীরশিলা (কন্নড় ভাষায়: বীরগল্লু, তামিল ভাষায়: নাটুকাল)[১] হল এক ধরনের স্মারক শিলা। এটি সাধারণত যুদ্ধে মৃত কোনও বীরপুরুষের সম্মানে স্থাপন করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় ১৮শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে স্থাপিত এই ধরনের বীরশিলাগুলি সারা ভারতের নানা স্থানে দেখা যায়। বীরশিলা এক ধরনের উৎকীর্ণ শিলাখণ্ড। এতে বিভিন্ন ধরনের কারুশিল্প, দেওয়ালচিত্র বা মূর্তি খোদিত থাকে।[২] এগুলি সাধারণত স্মারকশিলার আকৃতিবিশিষ্ট হয় এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে নিচে যুদ্ধের ঘটনাবলিও উৎকীর্ণ থাকে। ইতিহাসবিদ উপিন্দর সিংয়ের মতে, এই ধরনের স্মারকশিলা সর্বাধিক সংখ্যায় পাওয়া গিয়েছে ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে। কর্ণাটকে প্রায় ২,৬০০ বীরশিলা আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলির মধ্যে প্রাচীনতম শিলাটি খ্রিস্টীয় ৫ম শতাব্দীর।[৩] স্মারকশিলা স্থাপনের প্রথাটি শুরু হয়েছিল লৌহযুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০-৬০০০ অব্দ)। তবে বেশিরভাগ স্মারকশিলা স্থাপিত হয় খ্রিস্টীয় ৫ম থেকে ১৩ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে।[৪]
আবিষ্কার
[সম্পাদনা]একটি বীরশিলা সাধারণত তিনটি প্যানেলে বিভক্ত থাকে। তবে ঘটনা অনুসারে কখনও কখনও চারটি বা পাঁচটি প্যানেলও দেখা যায়। উপরের প্যানেলটিতে শিবলিঙ্গ প্রভৃতি দেবতার চিত্র থাকে। মধ্যের প্যানেলটিতে বীরপুরষটির ছবি। সেই ছবিতে দেখা যায় স্বর্গের অপ্সরারা তাকে একটি পালকিতে বা সিংহাসনে করে নিয়ে চলেছেন। নিচের প্যানেলটিতে যুদ্ধের দৃশ্য অঙ্কিত থাকে।[৫] কর্ণাটকের বেটাগেরিতে প্রাপ্ত বীরশিলাটি অন্যতম সুউচ্চ বীরশিলা। এটির উচ্চতা ১২ ফুট।[৬]
তামিলনাড়ু রাজ্যে পুরাতত্ত্ব বিভাগ কয়েকশো বীরশিলা আবিষ্কার করেছে। এগুলি যুদ্ধে নিজ সম্প্রদায় বা অঞ্চলের জন্য প্রাণদানকারী যোদ্ধাদের স্মৃতিতে স্থাপিত হয়েছিল। এই সব বীরশিলার গায়ে উৎকীর্ণ হয়েছে সংশ্লিষ্ট যোদ্ধার কার্যবিবরণী, যুদ্ধের বিবরণ এবং যে রাজা যুদ্ধ করেছিলেন, তার নাম। এই বীরশিলাগুলি একক বা সমষ্টি আকারে স্থাপিত হয়েছে। অনেক বীরশিলা কোনও গ্রামের বাইরে একটি সেচ পুষ্করিণী বা হ্রদের ধারে স্থাপিত হয়েছিল।[৭]
খ্রিস্টীয় ৯ম শতাব্দীর পল্লব রাজা দন্তীবর্মণের সময়কালের একটি বীরশিলায় এক যোদ্ধাকে সুন্দর পোশাক পরিহিত অবস্থায় একটি বর্শা হাতে অশ্বচালনা করতে দেখা যায়।[৮] উসিলামপট্টির পাপ্পাপট্টিতে আরেকটি বীরশিলা পাওয়া গিয়েছে। এটি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ১৮শ শতাব্দীর। এতে নায়কোচিত ভঙ্গিমায় এক যোদ্ধাকে দেখা যায়। তার পাশে দেখা যায় ফুল হাতে তার স্ত্রীকে। ২,৩০০ বছর আগে সঙ্গম যুগ থেকেই বীরশিলা স্থাপনের প্রথা চলে আসছে।[৯] ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ নায়ক বা নায়ক-উত্তর যুগ পর্যন্ত এই ধরনের শিলা স্থাপিত হয়েছে।[১০]
২০১৪ সালের মার্চ মাসে তুতিকোরিন জেলার বেল্লালানকোট্টাই থেকে খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দীর পাণ্ড্য রাজ্যের একটি বীরশিলা পাওয়া যায়। এতে তামিল ‘বট্টেলুট্টু’ লিপিতে একটি লেখ উৎকীর্ণ রয়েছে।[৪] আরেকটি বীরশিলা এক নারী তার স্বামীর উদ্দেশ্যে স্থাপন করেছিলেন। উক্ত ব্যক্তি গ্রামে বিচরণরত গবাদি পশুর উপর আক্রমণকারী এক চিতাবাঘকে মেরেছিলেন।[১১] সবক্ষেত্রেই বীরশিলা কোনও ব্যক্তির সম্মানে স্থাপিত হত না। আতাকুর শিলালিপি হল এমনই একটি বীরশিলা। এটি ৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত হয়। এতে ধ্রুপদি কন্নড় ভাষায় একটি কাব্যিক লেখ উৎকীর্ণ রয়েছে। এটি পশ্চিম গঙ্গ রাজা দ্বিতীয় বুটুগের প্রিয় কুকুরটির মৃত্যু উপলক্ষ্যে উৎকীর্ণ হয়। সেই কুকুরটি একটি বুনো ভালুকের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে মারা গিয়েছিল।[১২]
ছবি
[সম্পাদনা]-
প্রাচীন কন্নড় উৎকীর্ণ লেখ সহ খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীর বীরশিলা, তারকেশ্বর মন্দির, হাঙ্গল, কর্ণাটক
-
প্রাচীন কন্নড় উৎকীর্ণ লেখ সহ খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীর বীরশিলা, তারকেশ্বর মন্দির, হাঙ্গল, কর্ণাটক
-
প্রাচীন কন্নড় উৎকীর্ণ লেখ সহ খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীর বীরশিলা, তারকেশ্বর মন্দির, হাঙ্গল, কর্ণাটক
-
সাতটি প্যানেলযুক্ত প্রাচীন কন্নড় উৎকীর্ণ লেখ সহ খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীর বীরশিলা, সিদ্দাপুর তালুক, কর্ণাটক
-
সাতটি প্যানেলযুক্ত প্রাচীন কন্নড় উৎকীর্ণ লেখ সহ খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীর বীরশিলা, সিদ্দাপুর তালুক, কর্ণাটক
-
১২৮৬ খ্রিষ্টাব্দের প্রাচীন কন্নড় উৎকীর্ণ লিপি সহ যাদব রাজা রামচন্দ্রের সমসাময়িক বীরশিলা, কেদারেশ্বর মন্দির, বল্লিগাবি, শিমোগা জেলা, কর্ণাটক
-
১১৬০ খ্রিষ্টাব্দের প্রাচীন কন্নড় উৎকীর্ণ লিপি সহ কালচুরি রাজা বিজলের সমসাময়িক বীরশিলা, কেদারেশ্বর মন্দির, বল্লিগাবি, শিমোগা জেলা, কর্ণাটক
-
প্রাচীন কন্নড় উৎকীর্ণ লিপি সহ খ্রিস্টীয় ১১শ বা ১২শ শতাব্দীর বীরশিলা, কল্লেশ্বর মন্দির, বাগালি, দেবানগেরে জেলা, কর্ণাটক
-
১১৮০ খ্রিষ্টাব্দের প্রাচীন কন্নড় উৎকীর্ণ লিপি সহ কালচুরি রাজা অহবমল্লের সমসাময়িক বীরশিলা, কেদারেশ্বর মন্দির, বল্লিগাবি, শিমোগা জেলা, কর্ণাটক
-
১২৩৫ খ্রিষ্টাব্দের প্রাচীন কন্নড় উৎকীর্ণ লিপি সহ যাদব রাজা সিংহনের সমসাময়িক বীরশিলা, কৈতবেশ্বর মন্দির, কুবাটুর, শিমোগা জেলা, কর্ণাটক
-
খ্রিস্টীয় ১০ম শতাব্দীর প্রাচীন কন্নড় উৎকীর্ণ লিপি সহ বীরশিলা, ত্রিমূর্তি নারায়ণ গুডি, কর্ণাটক
-
খ্রিস্টীয় ১০ম শতাব্দীর প্রাচীন কন্নড় উৎকীর্ণ লিপি সহ বীরশিলা, ত্রিমূর্তি নারায়ণ গুডি, কর্ণাটক
-
পরবর্তী চালুক্য যুগের বীরশিলা, সিদ্ধেশ্বর মন্দির, হাভেরি, হাভেরি জেলা, কর্ণাটক
-
প্রাচীন কন্নড় উৎকীর্ণ লিপি সহ বীরশিলা, ১১২০ খ্রিষ্টাব্দ, আরাসিকেরে, কর্ণাটক
-
মুরুগামঙ্গলম বীরশিলা, তামিলনাড়ু
-
ম্নরসিংহপুরম বীরশিলা, খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দী, তামিলনাড়ু
-
টাটচম্পাডি বীরশিলা, তামিলনাড়ু
-
ওলাক্কারাবাডি বীরশিলা, খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দী, তামিলনাড়ু
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Filliozat, Jean (১৯৯১)। Religion, Philosophy, Yoga: A Selection of Articles। Motilal Banarsidass Publ.। পৃষ্ঠা 151।
- ↑ "Hero-stone Memorials of India"। Kamat Potpourri। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৩-১৫।
- ↑ Chapter "Memorializing death in stone", Singh (2009), p48
- ↑ ক খ T. S. Subramanian (মার্চ ৩০, ২০১৪)। "Hero-stone discovered in Tamil Nadu"।
- ↑ "Hungul. Sculptured memorial stone."। ১১ জুন ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ 1855। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য) - ↑ "12 feet high Viragal"। ৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ 1885। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য) - ↑ "Dolmens, Hero Stones and the Dravidian People"। ২০১৩-০৮-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৬-৩০।
- ↑ "Pallava period 'herostone' unearthed in Vellore dt."। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৩-১৫।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "2,300-year-old hero stones found in Theni district"। Chennai, India: The Hindu। ২০০৬-০৪-০৫। ২০০৬-০৪-০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৫-১৪।
- ↑ "'Hero stone' unearthed"। The Hindu। Chennai, India। ২০০৬-০৭-২২। ২০০৭-১০-০১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৩-১৭।
- ↑ "A hero stone tells a tale from eighth century"। The Hindu। Chennai, India। ২০০৬-০৭-২২। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-১০-১৩।
- ↑ Altekar (1934), p351
গ্রন্থপঞ্জি
[সম্পাদনা]- Singh, Upinder। A History of Ancient and Early Medieval India:From the Stone Age to the 12th Century। India: Pearsons Education। আইএসবিএন 978-81-317-1120-0।
- Altekar, Anant Sadashiv (১৯৩৪) [1934]। The Rashtrakutas And Their Times; being a political, administrative, religious, social, economic and literary history of the Deccan during C. 750 A.D. to C. 1000 A.D। Poona: Oriental Book Agency। ওসিএলসি 3793499।