পাকিস্তান–বাংলাদেশ মিত্রসংঘ প্রস্তাব
বাংলাদেশ–পাকিস্তান মিত্রসংঘ প্রস্তাব হলো একটি মিত্রসংঘের ধারণা যা প্রাক্তন প্রশাসনিক ইউনিট পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সাথে আরেক ইউনিট পশ্চিম পাকিস্তান বা ১৯৭১-পরবর্তী ইসলামি প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তানের একটি মিত্রসংঘ গঠনের প্রস্তাব করেছিল।
১৯৭১ সালে আহসান ফর্মুলা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে অঙ্গরাজ্য বানিয়ে সমগ্র পাকিস্তানকে একটি মিত্রসংঘে পরিণত করার প্রস্তাব করেছিল। অসহযোগ আন্দোলনের সময় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ মিত্রসংঘের প্রস্তাব করেছিল যা দেশটির তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ দলের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে পশ্চিম পাকিস্তানে কারাবরণ থেকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি মিত্রসংঘ গঠনের গোপন প্রস্তাব করেছিল।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলি ভুট্টো মিত্রসংঘের প্রস্তাব দিলে তিনি রাজি হোননি। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রপতির পদ খালি হওয়ায় তার পরে খন্দকার মোশতাক আহমেদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতা নিয়ে পাকিস্তানের সাথে বৈদেশিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টার প্রেক্ষাপটে দুই দেশের মধ্যে মিত্রসংঘ গঠনের একটি গুজব ছড়িয়ে পড়লে দ্বিদেশীয় মৈত্রী চুক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে কোনরকম মিত্রসংঘ বাস্তবায়ন করা হলে ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ভারত সরকার তাকে জানিয়ে দিয়েছিল।
পটভূমি
[সম্পাদনা]১৯৭১ সালের প্রথমদিকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে প্রস্তুতকৃত আহসান ফর্মুলা একটি মিত্রসংঘ গঠনের প্রস্তাব দেয় যেখানে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলি ভুট্টোকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানকে সেই প্রস্তাবিত মিত্রসংঘের রাষ্ট্রপতি করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।[১] ৬ জুলাই ২০০৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উন্মুক্ত করা গোপন নথিপত্র অনুযায়ী একই বছরে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার বদলে মিত্রসংঘের আশা করেছিলেন।[২] ১১ মার্চ ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাস ও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে প্রেরিত টেলিগ্রামে ঢাকার তৎকালীন মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাডের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী তৎকালীন পরিস্থিতিতে আহসান ফর্মুলার আদলে একটি মিত্রসংঘ গঠন ভালো সমাধান হতে পারতো।[৩]
ভারতীয় ঐতিহাসিক শ্রীনাথ রাঘবনের মতে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বাধীনতার দাবি প্রত্যক্ষভাবে না তুলে মিত্রসংঘের প্রস্তাব করেছিল যার উৎস পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীর মাঝে নায্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আকাঙ্খার মধ্যে নিহিত ছিল।[৪] ২৪ মার্চ ১৯৭১ সালে ঢাকায় পাকিস্তানের প্রস্তাবিত খসড়া শাসনতন্ত্রের অর্থনৈতিক বিভাগগুলো নিয়ে সকাল ও সন্ধ্যা দুই দফা দলটি এবং ইয়াহিয়া খান ও তার উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে আলোচনা হয়েছিল। দলের প্রতিনিধিরা খসড়া শাসনতন্ত্রে সংঘরাষ্ট্রের বদলে একটি মিত্রসংঘের প্রস্তাব করে।[ক] কিন্তু তা দলটির গঠনতন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় পাকিস্তান সরকার এর বিরোধিতা করে।[৫] অন্যদিকে জুলফিকার আলি ভুট্টো প্রস্তাবিত মিত্রসংঘ বাস্তবায়ন করার অর্থ প্রদেশগুলোকে প্রায় স্বাধীন করে দেওয়া আখ্যা দিয়ে প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন।[৬]
বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা
[সম্পাদনা]বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য জহুরুল কাইয়ূমের মাধ্যমে ভারতের কলকাতায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেলকে পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিদানের বিনিময়ে দুই অঞ্চলের মধ্যে একটি মিত্রসংঘ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের বার্তা প্রেরণ করেছিলেন।[৭] এই লক্ষ্যে তিনি মার্কিন সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে একটি বৈঠকের আয়োজনও করেছিলেন। এই কাজে মোশতাকের সমর্থক ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব মাহাবুব আলম চাষী যিনি মার্কিনদের মধ্যস্ততায় পাকিস্তানের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য একজন প্রতিনিধি চেয়েছিলেন। তবে প্রেরিত বার্তাটি ভারতের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের কাছে ফাঁস হয়ে যায়, তারা মোশতাককে মার্কিন সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির এক সদস্যের সাথে কলকাতার একটি হোটেলে সাক্ষাৎ করতে দেখেছিল। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদকে ব্যাপারটা জানানোর পর মুজিবনগর সরকার মোশতাককে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘের সম্মেলনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অপসারণ করে।[৮]
মার্কিন নথি অনুযায়ী যুদ্ধ শেষ হয়ে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নামে স্বাধীনতা লাভ করার পর জুলফিকার আলি ভুট্টো ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম ডি রজার্সকে দুটি দেশের মধ্যে একটি শিথিলতম মিত্রসংঘ গড়ে তোলার পক্ষে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।[৯] অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর তিনি ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের সময় পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে শিথিল গঠনতন্ত্রের মাধ্যমে একীভূত করার একটি প্রস্তাব দেন।[১০] এমনকি তিনি তখন বন্দি থাকা শেখ মুজিবুর রহমানকে সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের আদলে দুই দেশের মধ্যে একটি শিথিলতম সংঘরাষ্ট্র তথা মিত্রসংঘ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।[১১][১০] যদিও বঙ্গবন্ধু প্রস্তাবে তখন রাজি হোননি। ১৩ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনকে পাঠানো একটি চিঠিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ প্রস্তাবিত মিত্রসংঘের ব্যাপারে সতর্ক করে ভুট্টোকে সেটি গঠনের পরিকল্পনা থেকে বিরত রাখার জন্য আহবান করেছিলেন। তার মতে স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তখন বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে দেরি করলে দেশটির পূর্ব জোটে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল।[৯]
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। তৎকালীন সময় গুজব রটেছিল যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মধ্যকার একটি মিত্রসংঘ গঠিত হতে পারে। ১৮ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন নতুন রাষ্ট্রপতিকে তার কাছে থাকা চিরকুটের লেখাগুলো পড়ে শোনান যেখানে লেখা ছিল "যদি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করা হয় এবং কোনো দেশের সঙ্গে কনফেডারেশন করা হয়, তাহলে ভারতের সাথে থাকা বৈধ চুক্তির আওতায়[খ] ভারতের সেনাবাহিনী যথাযথ পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু আপনি যদি নাম পরিবর্তন এবং তথাকথিত কনফেডারেশনের ধারণা থেকে বিরত থাকেন, তাহলে ভারত ১৫ই অগাস্ট থেকে যাই ঘটুক না কেন, তাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসাবে বিবেচনা করবে"। চিরকুটের লেখা পড়ে শোনানোর প্রতিক্রিয়ায় মোশতাক বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন।[১২] সমর সেনের সাথে সাক্ষাতের পর মোশতাক মিত্রসংঘ গঠনের প্রচেষ্টার বিপরীতে ঘোষণা করেন যে সরকারি আইন, নীতিমালা ও কার্যক্রমে কোন পরিবর্তন আনা হবেনা।[১৩]
টীকা
[সম্পাদনা]- ↑ এর আগে দলটি ছয় দফা প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রদেশগুলোর স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল।
- ↑ বৈধ চুক্তি বলতে বাংলাদেশ–ভারত মৈত্রী চুক্তি ১৯৭২ বোঝানো হয়েছে।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ এহতিশাম, এস আখতার (১৯৯৮)। A Medical Doctor Examines Life on Three Continents: A Pakistani View (ইংরেজি ভাষায়)। আলগোরা পাবলিশিং। পৃষ্ঠা ১০২। আইএসবিএন 9780875866345। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৬।
- ↑ ইকবাল, আনোয়ার (৭ জুলাই ২০০৫)। "Sheikh Mujib wanted a confederation: US papers"। ডন (ইংরেজি ভাষায়)। ১৬ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ সাজেন, শামসুদ্দোহা (১১ মার্চ ২০২৪)। "Indomitable March: Bhutto's urgent appeal to Mujib"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। ২৪ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ ইয়েচুরি, আশীষ (৩০ ডিসেম্বর ২০১৩)। "Even in 1971, Awami League wasn't stating it wanted independence: Srinath Raghavan"। টাইমস অফ ইন্ডিয়া (ইংরেজি ভাষায়)। ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ আবু মো. দেলোয়ার হোসেন এবং এ.টি.এম যায়েদ হোসেন (২০১২)। "অসহযোগ আন্দোলন ১৯৭১"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ হায়দার, রশীদ (১৯৮৯) [প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৫]। অসহযোগ আন্দোলন: একাত্তর। ঢাকা: বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা ৯৫।
- ↑ "বাংলাদেশে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি"। জনকণ্ঠ। ১১ জানুয়ারি ২০১৫। ২৫ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ লিটন, শাখাওয়াত (১৪ আগস্ট ২০১৫)। "Mushtaque, a hero!"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। ১৪ আগস্ট ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ ক খ খান, মিজানুর রহমান (৯ জানুয়ারি ২০২৪)। "ভুট্টোর কনফেডারেশনে বঙ্গবন্ধুর না"। দৈনিক শিক্ষা। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ ক খ আহমেদ, ইনাম; লিটন, শাখওয়াত (১৬ ডিসেম্বর ২০১৫)। "After 1971 defeat, Bhutto dreamt of confederation"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ "Bhutto Said to Offer East a Loose Union"। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস (ইংরেজি ভাষায়)। ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭১। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ ইসলাম, সায়েদুল (১৪ আগস্ট ২০২৩)। "সপরিবারে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরের দুই সপ্তাহে যা ঘটেছিল"। বিবিসি। ১৪ আগস্ট ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ খান, আবেদ (২ অক্টোবর ২০১৯)। "মোশতাকের মীরজাফরি চাল"। দৈনিক জাগরণ। ৫ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।