ফুসতাত
ফুসতাত الفسطاط | |
---|---|
মিশরের রাজধানী, ৬৪১–৭৫০, ৯০৫–১১৬৮ | |
ডাকনাম: তাবুর শহর | |
মিশরে ফুসতাতের অবস্থান | |
স্থানাঙ্ক: ৩০°০′ উত্তর ৩১°১৪′ পূর্ব / ৩০.০০০° উত্তর ৩১.২৩৩° পূর্ব | |
বর্তমান | পুরনো কায়রোর অংশ |
রাশিদুন খিলাফত | ৬৪১–৬৬১ |
উমাইয়া খিলাফত | ৬৬১–৭৫০ |
ফাতেমীয় খিলাফত | ৯০৫–১১৬৮ |
প্রতিষ্ঠা | ৬৪১ |
জনসংখ্যা (১২শ শতাব্দী) | |
• মোট | ২,০০,০০০ |
ফুসতাত (আরবি: الفسطاط, al-Fusţāţ) বর্তমান মিশরের একটি প্রাচীন নগরী ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাবের শাসনামলে যার গোড়াপত্তন হয়েছিল। সেনাপতি আমর ইবনুল আসের নেতৃত্বে ৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে মুসলমানদের মিশর জয়ের পর রাজধানী স্থাপনের উদ্দেশ্যে নীল নদের তীরবর্তী স্থানে এই শহরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রায় দুই শত বৎসর এটি মিশরের রাজধানী ছিল। এটি এখন মাসর্ আল-আতিক্বাহ নামীয় পুরাতন কায়রো নগরীর অন্তর্ভুক্ত একটি এলাকা।
১২শ শতাব্দীতে শহরটি সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায়। এ সময় জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২,০০,০০০ জন।[১] ফুসতাত ছিল মিশরের প্রশাসনিক কেন্দ্র। ক্রুসেডারদের হাত থেকে ফুসতাতের সম্পদ দূরে রাখার জন্য উজির শাওয়ার ফুসতাতকে আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার আদেশের পূর্ব পর্যন্ত এর গুরুত্ব এরূপ ছিল। পরবর্তীতে শহরের বাকি অংশ কায়রোর অংশ করে নেয়া হয়। ফাতেমীয়রা ৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ফুসতাতের উত্তরে খলিফার রাজকীয় আবাস হিসেবে কায়রো গড়ে তুলেছিল। অঞ্চলটি এরপর শত বছর ধরে সংস্কারহীন অবস্থায় পড়ে থাকে এবং ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে।
রাজধানী যুগের অল্প কিছু দালান এখনো টিকে রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এখানকার অনেক ভূগর্ভস্থ নিদর্শন উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেক নিদর্শন কায়রোর ইসলামি শিল্প জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। মিশর ও আফ্রিকায় নির্মিত প্রথম মসজিদ আমর ইবনুল আস মসজিদ এখানে অবস্থিত।
মিশরের রাজধানী
[সম্পাদনা]প্রায় ৫০০ বছর যাবত ফুসতাত মিশরের রাজধানী ছিল। ৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে আব্বাসীয়দের বিদ্রোহের আগ পর্যন্ত ফুসতাতের কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ ছিল। বিদ্রোহ মিশর ছাড়াও সমগ্র আরব অঞ্চলকে প্রভাবিত করেছিল। আব্বাসীয়রা ক্ষমতা পাওয়ার পর বিভিন্ন রাজধানীকে অধিকতর নিয়ন্ত্রণযোগ্য এলাকায় স্থানান্তর করে। ইতিপূর্বে দামেস্ক খিলাফতের প্রধান রাজধানী ছিল। আব্বাসীয়রা বাগদাদে নতুন রাজধানী স্থাপন করে। এই ধরনের স্থানান্তর অন্যত্রও ঘটে। মিশরে আব্বাসীয়রা ফুসতাত থেকে রাজধানী সরিয়ে আব্বাসীয় শহর আল-আসকারকে নতুন রাজধানী করে। ৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এটি রাজধানী ছিল। ৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তুলুনিদের ক্ষমতা লাভের পর অল্পকালের জন্য উত্তরের শহর আল-কাতাইয়ে রাজধানী স্থানান্তর করা হয়।[২] আল-কাতাই ৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজধানী হিসেবে টিকে ছিল। এরপর আল-কাতাই ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং রাজধানী পুনরায় ফুসতাতে নিয়ে আসা হয়। ১১৬৮ খ্রিষ্টাব্দে উজির শাওয়ার ফুসতাত পুড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়ার পর ফুসতাত রাজধানী হিসেবে তার অবস্থান হারিয়ে ফেলে। এরপর মিশরের রাজধানী কায়রোতে স্থানান্তর করা হয়।[৩]
নাম ব্যুৎপত্তি
[সম্পাদনা]একটি ঘটনা থেকে ফুসতাতের নাম উদ্ভব হয়। মিশর বিজয়ের সময় সেনাপতি আমর ইবনুল আস ৬৪৬ খ্রিষ্টাব্দে আলেক্সান্দ্রিয়া যাত্রা করার আগে একটি পায়রা তার তাবুতে ডিম পাড়ে। এসময় রোমান ব্যবিলন দুর্গের উত্তরে তিনি শিবির স্থাপন করেছিলেন।[৪][৫] একারণে আমর ইবনুল আস তাঁবুটিকে অক্ষত রাখার নির্দেশ দেন এবং যুদ্ধযাত্রা করেন। যুদ্ধে বিজয়ের পর তিনি সৈনিকদেরকে তার তাবুর চতুঃপার্শ্বে তাঁবু স্থাপনের নির্দেশ দেন এবং নতুন রাজধানীর নাম দেন মিসর আল-ফুসতাত বা ফুসতাত মিসর।[৬] যথার্থ অনুবাদ না হলেও একে "তাবুর শহর" বলে ডাকা হয়।
মিসর শব্দটি সেমেটিক ধাতু থেকে উদ্ভূত। আরবিতে একে দেশ মিশর ছাড়াও বড় শহর বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। একারণে মিসর আল-ফুসতাত "তাবুর শহর" বোঝায়। ফুসতাত মিসর দ্বারা "মিশরের আচ্ছাদন" বোঝায়।[৭] মিশরীয়রা এখনো কায়রোকে "মিসর" বা "মাসর" বলে থাকে যদিওবা এটি সমগ্র দেশের নাম।[৮] সেনাপতির তাঁবু স্থাপনের জায়গায় ৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে মিশরের প্রথম মসজিদ হিসেবে আমর ইবনুল আস মসজিদ নির্মিত হয়।[২][৬]
প্রাথমিক ইতিহাস
[সম্পাদনা]ফুসতাত ৬৪১ সালে আরব সেনাপতি আমর ইবনুল আস উবাদাহ ইবনুল সামিতের, যিনি একজন মহান স্থপতির, সহায়তায় স্থাপন করেছিলেন। উবাদাহ ব্যক্তিগতভাবে আমর ইবনুল আস মসজিদ এবং এর কিবলা নির্মাণের তদারকি করেছিলেন।[৯][১০]
হাজার বছর ধরে বিভিন্ন রাজবংশের শাসনামলে মিশরের রাজধানী থিবস ও মেমফিসসহ বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তরিত হয়েছে। ৩৩১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মহান আলেকজান্ডার মিশর জয় করার পর ভূমধ্যসাগরের উপকূলে তার নামে নামকরণ করা আলেক্সান্দ্রিয়া নতুন রাজধানী হয়। প্রায় এক হাজার বছর পর্যন্ত এই অবস্থা অক্ষুণ্ণ থাকে। ৭ম শতাব্দীতে খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাবের শাসনামলে মুসলিমরা এই অঞ্চল জয় করে নেয়। তিনি একটি নতুন রাজধানী স্থাপন করতে চাইছিলেন। ৬৪১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে আলেক্সান্দ্রিয়ার পতন ঘটলে সেনাপতি আমর ইবনুল আস নীল নদের পূর্ব তীরে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন।[২]
প্রথমদিকে শহরের অধিবাসীরা ছিল সৈনিক ও তাদের পরিবার। শহরের গঠন অনেকটা সেনাঘাটির মত ছিল। আমর ইবনুল আস ফুসতাতকে উত্তর আফ্রিকা ও বাইজেন্টিয়ামের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য একটি ভিত্তি হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।[৬] তিউনিসিয়ায় ৬৭০ খ্রিষ্টাব্দে কাইরুয়ান প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত আফ্রিকায় আরব বিস্তৃতির প্রাথমিক ঘাঁটি হিসেবে ফুসতাত ব্যবহৃত হয়েছে।[১১]
সমগ্র ফুসতাত খিত্তা নামক বেশ কিছু গোত্রীয় এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছিল। এর কেন্দ্রে ছিল মসজিদ ও প্রশাসনিক ভবনসমূহ।[১২] অধিকাংশ বাসিন্দা ইয়েমেন থেকে আসে। এর পরেই ছিল পশ্চিম আরবের বাসিন্দারা। তাদের সাথে কিছু ইহুদি ও রোমান ভাড়াটে যোদ্ধাও নগরের অধিবাসী ছিল। মিশরে যোগাযোগের জন্য সাধারণত আরবি ভাষা মৌখিক ও লিখিতরূপে ব্যবহৃত হত। এর পাশাপাশি কপ্টিক ভাষা ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত ফুসতাতে প্রচলিত ছিল।[১৩]
উমাইয়া খিলাফতের সময় ফুসতাত মিশরের ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল। উমাইয়া খিলাফত ৬৬০ থেকে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। মিশর ছিল গভর্নর শাসিত একটি প্রদেশ। দামেস্ক, মদিনা, বাগদাদ এসব কেন্দ্রীয় অংশ থেকে গভর্নর নিয়োগ করা হত। ফুসতাত গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল। ৯ম শতাব্দীতে এর জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১,২০,০০০।[১৫] তিউনিসিয়া ভিত্তিক ফাতেমীয় সেনাপতি জাওহার আল-সাকিলি এই অঞ্চল দখল করার করেন। ৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ৮ আগস্ট তিনি ফুসতাতের উত্তরে একটি নতুন শহর স্থাপন করেন। এর নাম দেয়া হয় আল-কাহিরা যা কায়রো বলে পরিচিত।[১৬] ৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ফাতেমীয় খলিফা আল-মুইজ আল-মানসুরিয়া থেকে আল-কাহিরায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। তবে এসময় কায়রো ঠিক রাজধানী না বরং খলিফার রাজকীয় স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হত এবং তার দরবার ও সেনাবাহিনী এখানে অবস্থান করত। অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে ফুসতাত রাজধানী হিসেবে বজায় থাকে।[২] ফুসতাত বিস্তার লাভ করতে থাকে। ৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ভূগোলবিদ ইবনে হাওকাল তার লেখায় ফুসতাতকে বাগদাদের আয়তনের এক তৃতীয়াংশ বলে উল্লেখ করেছেন। ১১৬৮ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ এর জনসংখ্যা ২,০০,০০০ হয়।
ফুসতাত তার সমৃদ্ধি, ছায়াময় রাস্তা, বাগান ও বাজারের জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে। এখানে বহুতল বিশিষ্ট আবাসিক ভবন ছিল। এর মধ্যে কিছু ভবন সাত তলা পর্যন্ত উঁচু ছিল এবং এসব ভবনে কয়েকশত মানুষ থাকতে পারত। ১০ম শতাব্দীতে আল-মুকাদ্দাসি এদেরকে মিনার হিসেবে উল্লেখ করেন। অন্যদিকে ১১শ শতাব্দীর শুরুর দিকে পারস্যের পর্যটক নাসির খসরু কিছু ভবন চৌদ্দ তলা পর্যন্ত উঁচু বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি এসব ভবনের ছাদে বাগান ছিল বলে তিনি লিখেছেন যা সেচের জন্য ষাঁড় টানা পানি চাকা দ্বারা সম্পন্ন হয়।[১৭]
নাসির খসরু ফুসতাতের বাজারে বিক্রি হত এমন সুন্দর ও মনোরম পণ্যের কথা লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে মাটি ও স্ফটিকের তৈরি পণ্য এবং নানারকম ফুল ও ফল। শীতকালেও এসব ফুল ও ফল পাওয়া যেত। ৯৭৫ থেকে ১০৭৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ফুসতাত ছিল ইসলামি শিল্প ও স্ফটিক উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এবং বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী শহর।[১২][১৮][১৯] একটি সূত্র অনুযায়ী খলিফা মুইজকে প্রদান করা ফুসতাতের দৈনিক করের পরিমাণ বর্তমান মূল্যমানে প্রায় ১,৫০,০০০ মার্কিন ডলার ছিল। আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে ফুসতাতে স্পেন, চীন ও ভিয়েতনামের মত দূরবর্তী স্থানের শৈল্পিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। খননের মাধ্যমে বসতবাড়ি ও রাস্তার জটিল পরিকল্পনা কাঠামো খুঁজে পাওয়া গেছে। একটি মৌলিক ইউনিট কেন্দ্রীয় উঠানের চারপাশ ঘিরে থাকা অনেকগুলো কক্ষ নিয়ে গড়ে উঠে। উঠোনের প্রধান প্রবেশপথ হিসেবে আর্চযুক্ত তোরণ থাকত।[১২]
ধ্বংস ও পতন
[সম্পাদনা]১২শ শতাব্দীর মধ্যভাগে আল-আদিদ মিশরের খলিফা ছিলেন। তিনি কিশোর হওয়ার প্রশাসনে তার অবস্থান ছিল আনুষ্ঠানিক এবং প্রকৃত ক্ষমতা ছিল উজির শাওয়ারের হাতে। তিনি দীর্ঘদিন যাবত ক্রুসেডার এবং সিরিয়ার নুরউদ্দিন জেনগির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত ছিলেন। তিনি এই দুই পক্ষের মধ্যে মিত্রতা বদল করতেন এবং তাদেরকে একে অন্যের বিরুদ্ধে লিপ্ত করান। এর মাধ্যমে তাদের এক পক্ষ অন্য পক্ষ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত না হয়ে মিশর আক্রমণ করতে পারবে না এমনটা তিনি নিশ্চিত করেন।[২০]
জেরুজালেমের রাজা প্রথম আমালরিক ক্রুসেডারদের সীমানা বৃদ্ধির জন্য অনেক বছর ধরে মিশর আক্রমণের চেষ্টা করছিলেন। ১১৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই কাজে কিছু মাত্রায় সাফল্য লাভে সমর্থ হন। তিনি তার সেনাবাহিনী নিয়ে মিশর প্রবেশ করেন এবং বিলবাইস শহরে হানা দেন। শহরের প্রায় সকল অধিবাসীকে হত্যা করা হয়। এরপর তিনি ফুসতাতের দিকে রওনা দেন। তিনি শহরের দক্ষিণে শিবির স্থাপন করে। এসময় আল-আদিদের বয়স ছিল ১৮ বছর। আমালরিক খলিফার কাছে আত্মসমর্পণের জন্য বার্তা পাঠান এবং বলেন যে নাহয় বিলবাইসের মত ভাগ্য বরণ করতে হবে।[২১]
আমালরিকের হামলা অবশ্যম্ভাবী দেখতে পেয়ে তার হস্তগত না হওয়ার জন্য শাওয়ার ফুসতাত শহর জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন।[২২] মিশরীয় ইতিহাসবিদ আল-মাকরিজি (১৩৪৬-১৪৪২) এ প্রসঙ্গে বলেছেন:
শাওয়ার ফুসতাত খালি করার নির্দেশ দেন। তিনি নাগরিকদেরকে তাদের অর্থ ও সম্পদ ফেলে জীবন রক্ষার্থে সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেন। এই পলায়নের ভীতি ও বিশৃঙ্খলার কারণে পলায়নরত জনতাকে ভূতের বিশাল বহরের মত মনে হচ্ছিল.... কেউ কেউ মসজিদ ও হামামে আশ্রয় নেয়...বিলাবাইসের মত খ্রিষ্টানদের হত্যাকাণ্ডের প্রতীক্ষা করে। শাওয়ার ২০,০০০ ন্যাপথা পাত্র ও ১০,০০০ আলোক বোমা পাঠান এবং সেগুলো শহরময় বিতরণ করেন। অগ্নিশিখা ও ধোঁয়ায় শহর ভরে যায় এবং তা ভয়াবহভাবে আকাশ স্পর্শ করে। এই অগ্নিশিখা ৫৪ দিন পর্যন্ত ছিল।....[২২]
ফুসতাতের ধ্বংসের পর সিরিয়ান বাহিনীর আগমন হয় এবং তারা সফলভাবে আমালরিককে প্রতিহত করে। খ্রিষ্টানদের প্রতিহত করার পর সিরিয়ানরা মিশর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। শাওয়ারের অবিশ্বস্ততার জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং ফাতেমীয়দের শাসন কার্যত শেষ হয়ে যায়। সিরিয়ান সেনাপতি শিরকুহ ক্ষমতা লাভ করেন। এর কয়েকমাস পরে স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি মারা যাওয়ার পর তার ভাইপো সালাহউদ্দিন মিশরের ক্ষমতা পান। শিরকুহ আইয়ুবী শাসনের সূচনা করেছিলেন।[২১]
এসময় ফুসতাত একটি মৃতপ্রায় শহরতলী হয়ে পড়ে। সরকারি কাজের জন্য এরপর নিকটস্থ কায়রো স্থায়ীভাবে রাজধানী করা হয়। সালাহউদ্দিন কায়রো ও ফুসতাতকে দেয়াল দ্বারা ঘিরে একই শহর হিসেবে গড়ার প্রচেষ্টা চালান। তবে এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি।[২]
১১৬৬ খ্রিষ্টাব্দে মাইমুনিদস মিশরে এসে ফুসতাতে বসতি স্থাপন করেন। এখানে তিনি একজন চিকিৎসক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। তিনি সালাহউদ্দিনের পরিবার, উজির আল-কাদি-আল-ফাদিল ও সালাহউদ্দিনের উত্তরসূরিদের চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন। তাকে রাইস আল-উম্মা বা আল-মিল্লাহ (জাতির বা বিশ্বাসের প্রধান) বলে সম্মান করা হত। ফুসতাতে থাকাকালীন তিনি মিশনাহ তোরাহ (১১৮০ খ্রিষ্টাব্দ) ও দালালাতুল হাইরিন রচনা করেন।[২৩]
মামলুকদের শাসনামলে ফুসতাতের এলাকা ভাগাড় হিসেবে ব্যবহৃত হত। তবে এসময়ও এখানে কয়েক হাজার বাসিন্দা ছিল। তারা ছিল মূলত কুমার ও আবর্জনা সংগ্রাহক। আবর্জনার স্তর কয়েকশত বছর ধরে এভাবে জমা হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে জনসংখ্যা কমে যায়। ফলে একসময়ের ব্যস্ততম শহর কার্যত পরিত্যক্ত হিসেবে দেখা দেয়।[৫]
আধুনিক ফুসতাত
[সম্পাদনা]বর্তমানে পুরনো শহরের দালানকোঠার খুব অল্প টিকে রয়েছে। ফুসতাত, আল-আসকার ও আল-কাতাই এই তিনটি রাজধানী শহর বর্ধমান কায়রোর অংশ হয়ে পড়ে। পুরনো কায়রো বলে পরিচিত অংশে কিছু পুরনো ভবন টিকে রয়েছে। তবে তাদের অধিকাংশ সংস্কারহীন অবস্থায় রয়েছে।[৫][২৪]
ইবনে তুলুন মসজিদ এখানকার সবচেয়ে পুরনো স্থাপনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আল-কাতাই রাজধানী থাকাকালীন সময়ে এটি নির্মিত হয়। আমর ইবনুল আস মসজিদ আফ্রিকা ও মিশরের প্রথম মসজিদ হলেও এটি কয়েকদফা পুনর্নির্মিত হয়েছে যার কারণে আদি স্থাপনা আর পাওয়া যায় না।[৫]
ধারণা করা হয় যে আবর্জনার ফলে চাপা পড়া অনেক পুরনো নিদর্শন আরো প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে উদ্ধার করা সম্ভব। [৫] কিছু খননকার্য এখানে চালানো হয়েছে। পুরনো সড়ক এখনো দেখা যায় এবং কিছু ভবন কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু নিকটস্থ বস্তীর কারণে এখানে কাজ চালানো অসুবিধাজনক। উদ্ধারকৃত শৈল্পিক নিদর্শনগুলো কায়রোর ইসলামি শিল্প জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়।[২৫]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Williams, p. 37
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ Petersen (1999) p. 44
- ↑ AlSayyad, Nezar (২০১১)। Cairo (ইংরেজি ভাষায়)। Harvard University Press। পৃষ্ঠা 75। আইএসবিএন 978-0674047860।
- ↑ Yeomans, p. 15
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ Eyewitness, p. 124
- ↑ ক খ গ David (2000) p. 59
- ↑ Since it lacks the article on the word Miṣr it would not be "The Pavilion of the Metropolis".
- ↑ Worman, Ernest (অক্টোবর ১৯০৫)। "Notes on the Jews in Fustāt from Cambridge Genizah Documents"। Jewish Quarterly Review (ইংরেজি ভাষায়)। পৃষ্ঠা 1–39।
- ↑ "Masjid Amru Bin Ash Tempat Sujud Pertama di Afrika"। Republika Online (ইন্দোনেশীয় ভাষায়)। ২০১৯-১০-০৭। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-১২।
- ↑ "Seerah Sahaba"। www.khbofficial.com। ২০২২-০১-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-১২।
- ↑ Lapidus, p. 41
- ↑ ক খ গ Petersen (1999) p. 91
- ↑ Lapidus, p. 52. "In general, Arabic became the language of written communication in administration, literature, and religion. Arabic also became the primary spoken dialect in the western parts of the Middle East – Egypt, Syria, Mesopotamia and Iraq – where languages close to Arabic, such as Aramaic, were already spoken. The spread of Arabic was faster than the diffusion of Islam, but this is not to say that the process was rapid or complete. For example, Coptic was still spoken in Fustat in the 8th century."
- ↑ Mason, Robert B.; Keall, Edward J. (১৯৯০)। "Petrography of Islamic pottery from Fustat"। Journal of the American Research Center in Egypt (ইংরেজি ভাষায়)। 27। পৃষ্ঠা 165–184।
- ↑ Kjeilin, Tore। "Fustat" (ইংরেজি ভাষায়)। Encyclopaedia of the Orient। ২০২০-০৬-২৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৮-১৩।
- ↑ Beeson, Irene (সেপ্টেম্বর–অক্টোবর ১৯৬৯)। "Cairo, a Millennial" (ইংরেজি ভাষায়)। Saudi Aramco World। পৃষ্ঠা 24, 26–30। ২০০৭-০৯-৩০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৮-০৯।
- ↑ Doris Behrens-Abouseif (১৯৯২)। Islamic Architecture in Cairo (ইংরেজি ভাষায়)। Brill Publishers। পৃষ্ঠা 6। আইএসবিএন 90-04-09626-4।
- ↑ Mason (1995) pp.5–7
- ↑ Barghusen, Joan D., 1935- (২০০০)। Daily life in ancient and modern Cairo। Moulder, Bob,। Minneapolis, MN: Runestone Press। আইএসবিএন 0-8225-3221-2। ওসিএলসি 42689981।
- ↑ Maalouf, pp. 159–161
- ↑ ক খ Tyerman, Christopher (২০০৬)। God's War: a new history of the Crusades (ইংরেজি ভাষায়)। Belknap। পৃষ্ঠা 347–349। আইএসবিএন 978-0-674-02387-1।
- ↑ ক খ Dr. Zayn Bilkadi (জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫)। "The Oil Weapons" (ইংরেজি ভাষায়)। Saudi Aramco World। পৃষ্ঠা 20–27। ২০১১-০৬-০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৮-০৯।
- ↑ Hoffman, Edward (২০০৮)। The Wisdom of Maimonides (ইংরেজি ভাষায়)। Boston: Shambhala Productions। পৃষ্ঠা 163–165। আইএসবিএন 978-1-590-30517-1।
- ↑ Kessler, Adam T. (২০১২)। Song Blue and White Porcelain on the Silk Road (ইংরেজি ভাষায়)। Leiden: Koninklijke Brill। পৃষ্ঠা 431। আইএসবিএন 978-90-04-21859-8।
- ↑ Alison Gascoigne। "Islamic Cairo" (ইংরেজি ভাষায়)। egyptvoyager.com। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৮-১৩।
গ্রন্থপঞ্জি
[সম্পাদনা]- Abu-Lughod, Janet L. Cairo: 1001 Years of the City Victorious (Princeton University Press, 1971), আইএসবিএন ০-৬৯১-০৩০৮৫-৫
- Antoniou, Jim (মার্চ ১৯৯৮)। "Historic Cairo – rehabilitation of Cairo's historic monuments" (ইংরেজি ভাষায়)। Architectural Review।
- David, Rosalie (২০০০)। The Experience of Ancient Egypt (ইংরেজি ভাষায়)। London; New York: Routledge। আইএসবিএন 0-415-03263-6।
- Eyewitness Travel: Egypt (ইংরেজি ভাষায়)। Dorlin Kindersley Limited, London। 2001, 2007। আইএসবিএন 978-0-7566-2875-8। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য) - Ghosh, Amitav, In an Antique Land (Vintage Books, 1994). আইএসবিএন ০-৬৭৯-৭২৭৮৩-৩
- Lapidus, Ira M. (1988). A History of Islamic Societies. Cambridge University Press. আইএসবিএন ০-৫২১-২২৫৫২-৩.
- Maalouf, Amin (1984). The Crusades Through Arab Eyes. Al Saqi Books. আইএসবিএন ০-৮০৫২-০৮৯৮-৪.
- Mason, Robert B. (১৯৯৫)। "New Looks at Old Pots: Results of Recent Multidisciplinary Studies of Glazed Ceramics from the Islamic World"। Muqarnas: Annual on Islamic Art and Architecture (ইংরেজি ভাষায়)। Brill Academic Publishers। XII। আইএসবিএন 90-04-10314-7।
- Petersen, Andrew (১৯৯৯)। Dictionary of Islamic Architecture (ইংরেজি ভাষায়)। London; New York: Routledge। আইএসবিএন 0-415-21332-0।
- Yeomans, Richard (২০০৬)। The Art and Architecture of Islamic Cairo (ইংরেজি ভাষায়)। Garnet & Ithaca Press। আইএসবিএন 1-85964-154-7।
- Williams, Caroline (২০০২)। Islamic Monuments in Cairo: The Practical Guide (ইংরেজি ভাষায়)। American University in Cairo Press। আইএসবিএন 977-424-695-0।
আরও পড়ুন
[সম্পাদনা]- Bacharach, Jere L. (২০০৪)। Fustat Finds: Beads, Coins, Medical Instruments, Textiles, and Other Artifacts from the Awad Collection (ইংরেজি ভাষায়)। American University in Cairo Press। আইএসবিএন 977-424-393-5।
- Barekeet, Elinoar (১৯৯৯)। Fustat on the Nile: The Jewish Elite in Medieval Egypt (ইংরেজি ভাষায়)। BRILL। আইএসবিএন 90-04-10168-3।
- Kubiak, Wladyslaw (১৯৮৭)। Al-Fusṭāṭ, its foundation and early urban development (ইংরেজি ভাষায়)। Cairo, Egypt: American University in Cairo Press। আইএসবিএন 977-424-168-1।
- Scanlon, George T. (১৯৭৪)। "The Pits of Fustat: Problems of Chronology"। The Journal of Egyptian Archaeology (ইংরেজি ভাষায়)। The Journal of Egyptian Archaeology, Vol. 60। 60: ৬০–৭৮। জেস্টোর 3856171। ডিওআই:10.2307/3856171।
- Scanlon, George T.; Pinder-Wilson, Ralph (২০০১)। Fustat Glass of the Early Islamic Period: Finds Excavated by the American Research Center in Egypt, 1964–1980 (ইংরেজি ভাষায়)। Altajir World of Islam Trust। আইএসবিএন 1-901435-07-5।
- Stewart, W. A. (জুলাই ১৯২১)। "The Pottery of Fostat, Old Cairo"। The Burlington Magazine for Connoisseurs (ইংরেজি ভাষায়)। 39 (220): ১১–১৩ ১৬–১৮।