পুণ্ড্রবর্ধন
পুণ্ড্রবর্ধন | |
---|---|
অজানা (?~1280 BCE)–অজানা (?~300 BCE) | |
রাজধানী | মহাস্থানগড় |
প্রচলিত ভাষা | সংস্কৃত পালি |
ধর্ম | ঐতিহাসিক বৈদিক ধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম হিন্দুধর্ম |
সরকার | রাজতন্ত্র |
ঐতিহাসিক যুগ | ব্রোঞ্জ যুগ, লৌহ যুগ |
• প্রতিষ্ঠা | অজানা (?~1280 BCE) |
• বিলুপ্ত | অজানা (?~300 BCE) |
বর্তমানে যার অংশ | বাংলাদেশ ভারত (পশ্চিমবঙ্গ) |
বাংলার ইতিহাস |
---|
ধারাবাহিকের একটি অংশ |
পুণ্ড্রবর্ধন ছিল প্রাচীন যুগের উত্তরবঙ্গের একটি এলাকা যেখানে পুণ্ড্ররা বাস করত। পুণ্ড্ররা ছিল অনার্য একটি সম্প্রদায়।[১][২][৩]
নামকরণ
[সম্পাদনা]পুণ্ড্র নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বেশকিছু মতবাদ আছে। একটি মতবাদ অনুসারে, পাণ্ডুরোগ থেকে পুণ্ড্র নামের উৎপত্তি। পুণ্ড্রক্ষেত্রের (পুণ্ড্রভূমি) অধিকাংশ ব্যক্তিই এ রোগে ভুগত। পুণ্ড্র আখের একটি প্রজাতি। আর যেখানে আখের অত্যধিক ফলন হত তা পুণ্ড্রদেশ বা পুণ্ডভূমি নামে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৭ম-৮ম শতকের দিকে প্রাপ্ত বেদবাক্য অনুযায়ী পুণ্ড্র ছিল একটি অনার্য গোষ্ঠী যারা গণ্ডকী নদীর পূর্বদিকে বাস করত। ১ম খ্রিষ্টাব্দের মহাভারতও এই তথ্যটি সমর্থন করে। অশোকাবদান গ্রন্থে এটি প্রথমবার পুণ্ড্রবর্ধন নামে উল্লেখিত হয়। পুণ্ড্রদের আবাসস্থলই পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধন নামে খ্যাত হয়েছিল। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর মহাস্থান ব্রাহ্মীলিপিতে উল্লিখিত ‘পুদনগল’ (পূণ্ড্রনগর) ও বগুড়ার মহাস্থান যে অভিন্ন এবং পুণ্ড্রনগর যে পুণ্ড্রদের আবাসস্থল পুণ্ড্রবর্ধনের কেন্দ্র সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই।
পুণ্ড্রের জনগণ
[সম্পাদনা]পরবর্তী বেদবাক্য মতে পুণ্ড্র ছিল একটি জনগোষ্ঠী। মহাভারতের দিগ্বিজয় শাখায় তাদের আবাস রূপে মুঙ্গেরের পূর্বদিক এবং কোশীর তট (অন্য নাম সপ্তকোশী নদী) শাসনকারী যুবরাজের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গুপ্ত শাসনকালে উৎকীর্ণ লিপি বা তাম্রশাসন এবং প্রাচীন চীনা লেখকরা পুণ্ড্রবর্ধনকে উত্তরবঙ্গে পুণ্ড্রদের স্থান রূপে উল্লেখ করে।
পৌরাণিক কাহিনী
[সম্পাদনা]মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত উপাখ্যান অনুযায়ী অসুররাজ বলির পত্নী সুদেষ্ণার গর্ভে ঋষি দীর্ঘতমার পাঁচ সন্তান অঙ্গ, বঙ্গ, সুহ্ম, পুণ্ড্র, ও কলিঙ্গ জন্মলাভ করে। তারা তাদের নামে পাঁচটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
দীর্ঘতমা ধার্মিক ও বেদাদি গ্রন্থে বিদগ্ধজন ছিলেন। একদিন মাতার আদেশে দীর্ঘতমার পুত্রগণ তাঁকে ভেলায় ভাসিয়ে দিলে রাজা বলি তাঁকে ভেসে আসতে দেখেন। ভাসিয়ে দেয়ার কারণ ছিল তার অযাচিত যৌনাচার। রাজা বলি যখন তাকে ক্ষেত্রজ সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন তখন তিনি রানি সুদেষ্ণার গর্ভে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সূহ্মের জন্ম দেন।
সাম্রাজ্য
[সম্পাদনা]উত্তর ভারতে আর্য-ব্রাহ্মণ সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ার অনেক পরে বাংলায় এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বাংলায় বসবাসকারী অনার্য ব্যক্তিরা অনেক ক্ষমতাবান হওয়ার জন্য তারা আর্য সংস্কৃতির প্রভাবকে প্রতিহত করে। মৌর্যরাই প্রাচীন ভারতে সর্বপ্রথম বড় ধরনের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে সমর্থ হয় যার প্রাণকেন্দ্র ছিল বর্তমান পাটনার অন্তর্ভুক্ত পাটালিপুত্রা। পুণ্ড্রনগর থেকে এর দূরত্ব খুব বেশি না হওয়ায় মৌর্যদের পুণ্ড্রবর্ধন অধিকার করার সম্ভাবনা ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৫ সালের দিকে মৌর্যদের শাসনামল শেষ হয়ে যাবার পরে কিছু নির্দিষ্ট সময়ে বেশকিছু ক্ষুদ্র সাম্রাজ্যের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে ৪র্থ খ্রিষ্টাব্দে গুপ্তদের পুনর্জাগরণের পরে। গুপ্ত আমলের ধাতব পাত্রে তাদের সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রান্তের পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির কথা উল্লেখ আছে, যেখানে ভুক্তি বলতে সাম্রাজ্যের একটি বিভাগের কথা বলা হয়েছে। ষষ্ঠ শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্য পতনের মুখে পড়ে এবং তাদের অধিকৃত অঞ্চলসমূহ সম্ভবত ৫৬৭-৭৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রাজা সঙ্গতসেনের অধিকারে চলে যায়। বাংলা পূর্বে সমতট ও পশ্চিমে গৌড় নামক দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। কিছু নির্দিষ্ট প্রাচীন নথিতে পুণ্ড্রবর্ধনকে গৌড়ের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বলা হয়েছে। ৭ম খ্রিষ্টাব্দে এটি শশাঙ্কের সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।
পতন
[সম্পাদনা]চীনা পরিব্রাজক, হিউয়েন সাঙ ৬৩৯-৪৫ সালে পুণ্ড্রবর্ধন এলাকায় ভ্রমণ করেন। তিনি কাজানগালা থেকে কামাপুরা হয়ে পুণ্ড্রবর্ধনে যান। তবে তার ভ্রমণ নির্দেশিকাতে তিনি সে সময়ে পুণ্ড্রবর্ধনে কোন রাজা ছিল বলে উল্লেখ করেননি।
জুয়ানজাং পুণ্ড্রবর্ধন সম্পর্কে নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি দেন:
"এখানে ২০টি বৌদ্ধ মঠ এবং ৩০০০ এরও বেশি ভিক্ষু ছিলেন যারা “মহাযান ও হীনযান”কে অনুসরণ করতেন; দেব-মন্দিরগুলোর সংখ্যা ১০০ ছিল এবং বিভিন্ন শ্রেণীর অনুসারীরা ছড়িয়ে থাকত, দিগম্বর নির্গ্রন্থের সংখ্যা ছিল অসংখ্য।"
নির্দিষ্ট তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, ৭ম-৮ম শতকে পুণ্ড্রবর্ধন তার প্রাচুর্য হারিয়ে ফেলেছিল। মহাস্থানগড়ের নৃতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে জানা যায়, পাল আমলের সময় ১২শ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দুর্গের ব্যবহার করা হয়েছিল, তবে এটি তেমন কোন শক্তি কেন্দ্র ছিল না। এটি চন্দ্রবংশের রাজাদের ও ভোজ ভার্মার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ত্রয়োদশ শতকে মুসলিম শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে তারা হয়ত এটিকে শাসনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে তখন আর এর তেমন কোন গুরুত্ব ছিল না। এটি ক্রমশ তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে এবং পারিপার্শ্বিক এলাকার একটি অংশে পরিণত হয়। পুণ্ড্রবর্ধননগর বা পুণ্ড্রবর্ধনপুর এর পরিচয় হারিয়ে মহাস্থান নামে সূচীত হতে থাকে।
ইসলামের প্রসার
[সম্পাদনা]মহাস্থানে শাহ সুলতান বালখি মাহীসওয়ার মাজহার যুদ্ধে মহাস্থানগড়ের রাজা পরশুরামকে পরাজিত করে এবং এলাকার মানুষকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করে বসতি স্থাপন করে।[৪][৫]
সীমানা
[সম্পাদনা]বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের অন্তর্ভুুক্ত রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা এবং বাংলাদেশ ও ভারতের দিনাজপুর পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বুধগুপ্তের সময় দামোদরপুর তাম্রশাসন শিলালিপি অনুসারে (আনুমানিক ৪৭৬-৯৪ খ্রিস্টাব্দ) পুণ্ড্রবর্ধনের উত্তর সীমা হিমালয় ছিল। পাল যুগে পুণ্ড্রবর্ধনের প্রশাসনিক ও আঞ্চলিক এখতিয়ার সম্প্রসারিত হয়। পাল, চন্দ্র ও সেন যুগে পুণ্ড্রবর্ধনে উত্তরবঙ্গের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে এলাকা অন্তর্ভুক্ত ছিল। [২] বরেন্দ্রী বা বরেন্দ্রী-মণ্ডলা ছিল পুণ্ড্রবর্ধনের একটি মহানগর জেলা। এটি বেশ কয়েকটি শিলালিপি দ্বারা সমর্থিত।[৩]বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রীর প্রাথমিকভাবে দশম শতাব্দী থেকে উল্লেখ পাওয়া যায়, যখন পুণ্ড্রবর্ধনের পতন হয়েছিল। [৬]
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গ মানেই পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তি নয়, যাকে আমরা এখন পূর্ববঙ্গ বলি তাও পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির অংশ ছিল। লক্ষ্মণ সেনের পুত্র কেশব সেনের শাসনামলের তাম্রশাসন শিলালিপি অনুসারে , দ্বাদশ শতাব্দীতে পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তিতে বিক্রমপুর পর্যন্ত এলাকা অন্তর্ভুক্ত ছিল। ”[৭] দক্ষিণে পুণ্ড্রবর্ধন সুন্দরবনের অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।[৮]
এই অঞ্চলের অসংখ্য জলপথ ছিল পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। প্রাচীন সাহিত্যে কিছু রাস্তার উল্লেখ আছে। সোমদেব কথাসরিতসাগরে পুণ্ড্রবর্ধন থেকে পাটলিপুত্র পর্যন্ত একটি রাস্তার উল্লেখ করেছেন। জুয়ানজং কাজাংলা থেকে পুণ্ড্রবর্ধন ভ্রমণ করেছিলেন, তারপরে একটি প্রশস্ত নদী অতিক্রম করে কামরূপে এগিয়ে যান। পুণ্ড্রবর্ধন থেকে মিথিলা পর্যন্ত একটি রাস্তা, তারপর পাটলিপুত্র এবং বুদ্ধগয়া হয়ে বারাণসী এবং অযোধ্যায় যাওয়ার এবং শেষ পর্যন্ত সিন্ধু এবং গুজরাটের দিকে যাওয়ার রাস্তার উল্লেখ রয়েছে। এটি অবশ্যই একটি প্রধান বাণিজ্য রুট ছিল। [৯]
আচার্য ভদ্রবাহুর জন্মস্থান
[সম্পাদনা]চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আধ্যাত্মিক শিক্ষক, জৈন আচার্য ভদ্রবাহু পুণ্ড্রবর্ধনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।[১০]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Hossain, Md. Mosharraf, Mahasthan: Anecdote to History, 2006, pp. 69-73, Dibyaprakash, 38/2 ka Bangla Bazar, Dhaka, আইএসবিএন ৯৮৪-৪৮৩-২৪৫-৪
- ↑ ক খ সুচন্দ্রা ঘোষ (২০১২)। "পুন্ড্রবর্ধন"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ ক খ Majumdar, Dr. R.C., History of Ancient Bengal, First published 1971, Reprint 2005, p. 10, Tulshi Prakashani, Kolkata, আইএসবিএন ৮১-৮৯১১৮-০১-৩.
- ↑ উদ্ধৃতি ত্রুটি:
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়;Hossain 1
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি - ↑ Khokon, Leaquat Hossain, 64 Jela Bhraman, 2007, p.129, Anindya Prokash, Dhaka.
- ↑ Roy, Niharranjan, p. 116.
- ↑ Bandopadhyay, Rakhaldas, p. 49
- ↑ Roy, Niharranjan, p.85,
- ↑ Roy, Niharranjan, pp. 91-93
- ↑ Majumdar, R.C. (১৯৭১)। History of Ancient Bengal (1971 ed.)। Calcutta: G.Bharadwaj & Co। পৃষ্ঠা 12, 13.।