বিষয়বস্তুতে চলুন

নেপালের সংস্কৃতি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
দুইজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি একটি ঐতিহ্যবাহী ঘরে দশাইন (নেপালি হিন্দুদের মহান উৎসব) উপলক্ষে টিকা প্রদান করছেন।

নেপালের সংস্কৃতি দেশটির ১২৫টি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্কৃতির সমন্বয়ে গঠিত।[] নেপালের সংস্কৃতি সঙ্গীতনৃত্য; শিল্পকারুশিল্প; লোককথা; ভাষাসাহিত্য; দর্শনধর্ম; উৎসবঅনুষ্ঠান; খাদ্যপানীয়ের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

নৃত্য ও সংগীত

[সম্পাদনা]
২০১৭ সালে আর্লউডের গফ হুইটলাম পার্কে উভাউলি কিরাটি উৎসবে সাংস্কৃতিক পোশাকে নারীরা।
নাচের জন্য ব্যবহৃত নেপালি ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ি পোশাক

কিংবদন্তিগুলি বলে যে, নেপালে নৃত্যের উৎপত্তি হয়েছিল ভগবান শিবের বাসস্থান হিমালয়ে, যেখানে তিনি তান্ডব নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন।[] এটি ইঙ্গিত করে যে নেপালের নৃত্যের ঐতিহ্য অত্যন্ত প্রাচীন এবং অনন্য। উচ্চতা এবং জাতিগত বৈচিত্র্যের কারণে, নেপালের নৃত্যের শৈলী এবং পোশাকেও কিছুটা পরিবর্তন আসে। বিবাহের সময় দিশকা নামে একটি নৃত্য পরিবেশিত হয়, এতে পায়ের জটিল পদক্ষেপ এবং হাতের নড়াচড়া থাকে।[] এই নৃত্যের সংগীত এবং বাদ্যযন্ত্র থিমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হয়। যেমন: ফসল কাটার সময়, বিবাহের অনুষ্ঠান, যুদ্ধের কাহিনী, প্রেম এবং গ্রামাঞ্চলের দৈনন্দিন জীবনের নানা গল্প এবং বিষয়কে কেন্দ্র করে পরিবর্তিত হয়। এছাড়াও ময়ূর নৃত্য এবং থারু সম্প্রদায়ের লাঠি নৃত্যও পরিবেশিত হয়।[]

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, নেপালে ১২৩ টি ভাষা প্রচলিত রয়েছে। এদের অধিকাংশই ইন্দো-আর্য বা তিব্বতি-বর্মী ভাষা পরিবারের অন্তর্গত। দেশটির প্রধান ভাষাগুলো (মাতৃভাষা হিসেবে কথা বলার হার) হল: নেপালি (৪৪.৬%), মৈথিলি (১১.৭%), ভোজপুরি (৬%), থারু (৫.৮%), তামাং (৫.১%), নেপাল ভাসা (৩.২%), মাগার (৩%) এবং বাজিকা (৩%), এবং দোতেলি (৩%)।[]

নেপালি ভাষা, দেবনাগরী লিপিতে লেখা হয়। এটি নেপালের সরকারি ভাষা এবং নেপালের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে এই ভাষা।

ধর্ম ও দর্শন

[সম্পাদনা]
নেপালি হিন্দু বিবাহের শোভাযাত্রা; বরকে কনের ভাই বা আত্মীয়রা বহন করছে
দক্ষিণ নেপালের একটি বৌদ্ধ মঠ

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, নেপালের জনসংখ্যার ৮১.৬% হিন্দু ধর্মাবলম্বী। প্রায় ৯% জনসংখ্যা বৌদ্ধ ধর্ম অনুসরণ করে। প্রায় ৪.২% ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করে এবং ৩.৬% স্থানীয় কিরাত ধর্ম অনুসরণ করে। আনুষ্ঠানিকভাবে খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা, জনসংখ্যার ১% এর চেয়েও কম।

নেপালে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের ঐতিহ্য দুই হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। লুম্বিনীতে গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং কাঠমান্ডুর পশুপতিনাথ মন্দিরটি হিন্দুদের একটি পুরানো এবং বিখ্যাত শিব মন্দির। নেপালে আরও বেশ কিছু মন্দির এবং বৌদ্ধ মঠ রয়েছে, সেইসাথে অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর উপাসনালয় রয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে, নেপালি দার্শনিক চিন্তাধারা হিন্দু ও বৌদ্ধ দর্শনের আদর্শ এবং ঐতিহ্য দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত, যার মধ্যে রয়েছে কাশ্মীর শৈববাদ, তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের নিয়ংমা স্কুল, ভক্তপুরের কর্মচার্যদের কাজ এবং তন্ত্র সাধনা। তন্ত্র সাধনা নেপালের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে, যার মধ্যে পশু বলির প্রথাও অন্তর্ভুক্ত। পাঁচ ধরনের পশু (যা সব সময় পুরুষ পশু হওয়া আবশ্যক) বলির জন্য গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। এগুলো হল: মহিষ, ছাগল, ভেড়া, মুরগি এবং হাঁস। গরু অত্যন্ত পবিত্র প্রাণী এবং কখনোই বলির জন্য গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না।

উৎসব ও অনুষ্ঠান

[সম্পাদনা]
একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি কনিষ্ঠদের দশাইন টিকা দিচ্ছেন
নেপালে উৎসবের সময়র ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিহিত কাঠমান্ডুর হিন্দু মেয়েরা

নেপালের বেশ কিছু উৎসব একদিন থেকে শুরু করে কয়েক দিন পর্যন্ত চলে। হিন্দু ও বৌদ্ধপ্রধান দেশ হওয়ায় নেপালের বেশিরভাগ উৎসবই ধর্মীয়। নেপালের উৎসবগুলোর মূল ভিত্তিই হল হিন্দুধর্ম, কারণ দেশের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ হিন্দু। বৌদ্ধধর্ম হচ্ছে নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম এবং জনসংখ্যার ৯ শতাংশ। বৌদ্ধধর্মও নেপালের সাংস্কৃতিক উৎসবগুলোকে প্রভাবিত করেছে। দশাইন বা বিজয়া দশমী হচ্ছে নেপালের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। সাধারণত দশাইন সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝিতে অর্থাৎ বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার ঠিক পরেই অনুষ্ঠিত হয়। এটি "দানবদের উপর বিজয়ের দিন"। নেওয়ার সম্প্রদায় এই উৎসবটিকে মোহনী নামে উদযাপন করে। তিহার বা দীপাবলি, হোলি, সরস্বতী পূজা, রাখীবন্ধন, জন্মাষ্টমী, গাই জাত্রা, নাগ পঞ্চমী, তীজ, ছট, কার্তিক পূর্ণিমা, মাঘী সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি, মহা শিবরাত্রি এবং ছেচু নেপালের ব্যাপকভাবে উদযাপিত গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। নভেম্বর মাসে চন্দ্র ক্যালেন্ডারের নববর্ষের দিন নেপাল সংবৎ উদযাপিত হয়। নেপালে বছরব্যাপী বেশ কয়েকটি যাত্রা অনুষ্ঠিত হয় এবং কিছু অঞ্চলে এ উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়।

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের মধ্যে রয়েছে বুদ্ধ পূর্ণিমা (বুদ্ধের জন্ম উদযাপন)[], মহা শিবরাত্রি (শিবের উৎসব)। মহা শিবরাত্রি উদযাপনের সময় কিছু মানুষ অতিরিক্ত মদ্যপান করেন এবং চরস সেবন করেন। শেরপারা, যারা মূলত উচ্চতর অঞ্চল এবং মাউন্ট এভারেস্ট এলাকায় বসবাস করেন, তারা বিশ্বের মঙ্গল কামনায় মানি রিমদু নামক উৎসব পালন করেন।

বেশিরভাগ উৎসবের মধ্যে নাচ এবং গান অন্তর্ভুক্ত থাকে এবং উৎসবের সময় ও বিশেষ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের বিশেষ খাবার খাওয়া হয়।

সাগান অনুষ্ঠান হলো পাঁচটি খাবারের (সিদ্ধ ডিম, শুকনো মাছ, মাংস, ডাল দিয়ে তৈরি পিঠা এবং চালের মদ) আচারিক উপস্থাপন, যা তান্ত্রিক ঐতিহ্য অনুযায়ী সৌভাগ্য বয়ে আনার জন্য আয়োজন করা হয়।

স্থাপত্য এবং প্রত্নতত্ত্ব

[সম্পাদনা]
বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের সোনালি প্রলেপযুক্ত ব্রোঞ্জের মূর্তি, নেপাল, ১৬শ শতাব্দী
১৯০৫ সালের একজন নেপালি মহিলার একটি চিত্রকর্ম

নেপাল সম্পদ সংঘ (নেপাল হেরিটেজ সোসাইটি) কাঠমান্ডু উপত্যকার বাইরে নেপালের ১,২৬২টি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের একটি তালিকা সংকলন করেছে।[]

খেলাধুলা

[সম্পাদনা]

সরকার ভলিবলকে দেশের জাতীয় খেলা হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর আগে জাতীয় খেলা ছিল ডান্ডি বিয়ো

প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দাহালের বালুওয়াটারের বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক মন্ত্রিসভা বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ভলিবলকে জাতীয় খেলা হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। নেপাল ভলিবল অ্যাসোসিয়েশন দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিল যে, দেশের ৭৫টি জেলায় খেলা হয়ে আসা এই খেলাটিকে জাতীয় খেলা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।


জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক সদস্য সচিব যুবরাজ লামা জাতীয় খেলা নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, আর বর্তমান সদস্য সচিব কেশব কুমার বিস্তা জাতীয় খেলা হওয়ার জন্য সুপারিশ করেছিলেন।[]

চিত্রশালা

[সম্পাদনা]

আরো দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "2011 Nepal Census Report" (পিডিএফ)। ১৮ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। 
  2. Shanmuganathan, Thilagavathi (২০১৪)। "A pragmatic analysis of Lord Shiva's dance": 95–115। আইএসএসএন 1613-3668ডিওআই:10.1515/ijsl-2014-0019। ২০২১-১১-১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-১০ 
  3. Gubhani, Juhee। "Re-Visiting the Question: Are Rājopādhyāyas Newārs of Nepal?" 
  4. McDonnaugh, Christian। "The mythology of the Tharu: aspects of cultural identity in Dang, West Nepal" (পিডিএফ)। ২০২০-০৭-২৯ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-১০ 
  5. "Major highlights" (পিডিএফ)। Central Bureau of Statistics। ২০১৩। পৃষ্ঠা 4। ১৭ জুলাই ২০১৩ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০১৩ 
  6. "Buddha Jayanti"। We All Nepali। ২০১৫-০৫-০৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৬-০১ 
  7. Inventory of heritage sites in Nepal। IUCN Nepal। ১৯৯৭। জুলাই ২১, ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১৫, ২০১১ 
  8. "Volleyball declared national game | the Himalayan Times"। ২৪ মে ২০১৭। ২০১৯-০৫-০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-০৭ 

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]