দুঃখের বছর
ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী দুঃখ বছর (আরবি: عام الحزن, প্রতিবর্ণীকৃত: ‘Ām al-Ḥuzn , এছাড়াও কষ্টের বছর অনুবাদ করা হয়) হল সেই হিজরি বছর যখন মুহাম্মদ সা. এর স্ত্রী খাদিজা এবং তার চাচা ও রক্ষক আবু তালিব মারা যান। বছরটি প্রায় আনুমানিক ৬১৯ খ্রিস্টাব্দে [১] [২] বা মুহাম্মদ সা. এর প্রথম ওহীর দশম বছরের সাথে মিলেছিল।
আবু তালিবের মৃত্যুর পরে আবু তালিবের (যিনি বনু হাশিমের প্রধানও ছিলেন) প্রদত্ত বংশ সুরক্ষা হারিয়ে যাওয়ার কারণে মুহাম্মদ সা. দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তিনি মক্কায় তার বিরোধীদের দ্বারা শারীরিক আক্রমণের লক্ষ্য হতে শুরু করেছিলেন। তিনি সাহায্যের সন্ধান করতে এবং বাসিন্দাদের ইসলামে দাওয়াত দিতে তায়েফ পরিদর্শন করেছিলেন। তবে তায়েফবাসী তাকে প্রত্যাখ্যান করে। মক্কা ফেরার পথে তিনি একাধিক বিশিষ্ট মক্কীর কাছে সুরক্ষা চেয়ে আবেদন করেছিলেন। বনু নওফাল বংশের প্রধান মুতিম ইবনে আদী তাঁর অনুরোধ মেনে মুহাম্মদ সা. কে নগরীতে নিয়ে যান এবং মুহাম্মদকে গোত্র সুরক্ষার অধীনে রাখার ঘোষণা দেন।
খাদিজার মৃত্যু
[সম্পাদনা]খাদিজা, মুহাম্মদ(সাঃ) এর প্রথম এবং ২৫ বছর বয়সে বিয়ে করা স্ত্রী। খাদিজার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুহাম্মাদ দ্বিতীয় বিবাহ করেন নাই। ৬১৯ খ্রিস্টাব্দে ৬৫ বছর বয়সে খাদিজা মারা যান। [১] এই সময়ে মুহাম্মদ(সাঃ) এর বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি ছিলো। খাদিজা মুহাম্মাদ(সাঃ) এর পরিবারের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার অল্প কাল পরেই মারা যান।[১] এই নিষেধাজ্ঞার মূল উদ্দেশ্য ছিলো কেউ মুহাম্মাদ(সাঃ) এর পরিবারের সঙ্গে কোন প্রকার খাদ্য কিংবা সরঞ্জাম লেনদেন করতে পারবে না। এতে তাদের পরিবারে খাদ্যসংকট দেখা দেয়। [২]
আবু তালিবের মৃত্যু
[সম্পাদনা]মুহাম্মদের চাচা আবু তালিব ছিলেন মুহাম্মদের বংশ বানু হাশিমের প্রধান। আবু তালিবের বাড়িতে মুহাম্মদ (যিনি এতিম ছিলেন) তাঁর দাদা আবদুল আল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর থেকে বাস করতেন। [১] বংশীয় প্রধান হিসাবে তিনি মুহাম্মদকে সুরক্ষা দিতেন। ইসলামের দিকে আহ্বানের কারণে মুহাম্মদ কুরাইশ গোত্রের কিছু লোকের শত্রুতে পরিণত হন। তারা তাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করতো। সেজন্যে মুহাম্মাদের বংশীয় সুরক্ষার প্রয়োজন ছিলো। যেটা গোত্রপ্রধান প্রদান করতে পারতেন। [১] মক্কার রীতিনীতি অনুসারে এ জাতীয় সুরক্ষা প্রদানের নিয়ম ছিল।
খাদিজা মারা যাওয়ার, (৩/৫ দিন পর) পরপরই আবু তালিব গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। [১] মুহাম্মাদকে রক্ষা করার পরেও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি এবং তাঁর মৃত্যুর পরে মুহাম্মদ তাকে শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। [১] মৃতুশয্যার কাছে উপস্থিত আবু তালিবের ভাই আল-আব্বাস ভেবেছিলেন যে তিনি আবু তালিবকে শাহাদা পাঠ করতে শুনেছেন, কিন্তু মুহাম্মদ শুনতে পান নাই। [১] মুহাম্মাদ তার চাচার জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে যাচ্ছিলেন এমন সময়ে তিনি ঐশীবানী প্রাপ্ত হন। কোরআনে বলা হয়েছে, বিশ্বাসীদের আল্লাহর কাছে অবিশ্বাসীদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করা অনুচিত এমনকি যদি তারা আপন আত্মীয়ও হয়।[৩] [৪]
সুরক্ষা হারানো
[সম্পাদনা]আবু তালিবের মৃত্যুর অর্থ হ'ল মুহাম্মদ আর তাঁর বংশের সুরক্ষার সুবিধা আর পাবেন না। আবু তালিবের ভাই আবু লাহাব প্রধান হয়েছিলেন, যিনি মুহাম্মাদ এর সুরক্ষার পক্ষে নামমাত্র ছিল, [১] এবং মুহাম্মদ তার রক্ষাকারী হতে চায় এমন অন্য কোন প্রধানকে খুঁজে পেলেন না। [২] তৎকালীন মক্কা্র প্রথা অনুসারে এর অর্থ হ'ল তিনি প্রতিরক্ষার বাইরে এবং কেউ দায়মুক্তি দিয়ে তাকে হত্যা করতে পারে। [২] [৩]
মক্কায় মুহাম্মদের বিরুদ্ধবাদীগণ তার সাথে দুর্ব্যবহার করতো এবং শারীরিকভাবে আক্রমণ করতে থাকে। [১] একজন হামলাকারী তার বাড়ির পাশ দিয়ে গেল এবং তার রান্নার পাত্রের মধ্যে ময়লা ছুড়ে দেয়। অন্য একজন যখন তাঁর উঠানে প্রার্থনা করছিলেন তখন রক্ত ও মলমূত্রের সহ একটি ভেড়ার নাড়িভূড়ি নিক্ষেপ করলে। [১] অপর একজন হামলাকারী কাবা থেকে আসার সময় তার মুখে এক মুষ্টি ময়লা ফেলে দেয়।[১] তাঁর কন্যা যখন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির ময়লা পরিষ্কার করেছিলেন, তখন তিনি তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন যে "আল্লাহ তোমার পিতাকে রক্ষা করবেন।" এবং মন্তব্য করেছিলেন যে আবু তালিবের মৃত্যুর পরে কুরাইশরা তার সাথে আরও খারাপ আচরণ করেছিল। [১] [৫]
তায়েফ পরিদর্শন করুন
[সম্পাদনা]যেহেতু মক্কার পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে গিয়েছিল, মুহাম্মদ তায়েফের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।[১] তায়েফ মক্কা থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত। তায়েফে তিনি বনু থাকিফ গোত্রের সেই সময়কার নেতা তিন ভাইয়ের কাছে যান।[১] তিনি সেই তিন ভাইকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেন। [১] তারা তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। মুহাম্মদ চলে যাওয়ার পরে তারা তাদের দাস ও চাকরদের তাকে হয়রান করার জন্য প্রেরণ করে। [১] মুহাম্মাদ আক্রান্ত হয়ে একটি আঙুর বাগানে আশ্রয় গ্রহণ করে। আঙুর বাগানের মালিক ছিলো মক্কার কুরাইশি ভাই উতবা এবং শায়বা। তারা তাদের গোত্রের মানুষের প্রতি সহানুভূতিপূর্বক তাদের খ্রিস্টান দাস আদ্দাসকে পাঠান মুহাম্মাদকে আঙুর খেতে দিতে। আঙুর খেতে দেওয়ার সময় আদ্দাস মুহাম্মাদের সাথে কথা বলেন। আদ্দাস নিনেভাইট নবী জোনাহ সম্পর্কে মুহাম্মাদের জ্ঞান দেখে বিস্মিত হয়।[১]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]গ্রন্থ-পঁজী
[সম্পাদনা]- Al-Mubarakpuri, Safiur-Rahman (২০১৪-০৬-০৯)। The Sealed Nectar। Darussalam Publishers।
- Armstrong, Karen (২০০৭-১২-১৮)। Islam: A Short History। Random House Publishing Group। আইএসবিএন 978-0-307-43131-8। Armstrong, Karen (২০০৭-১২-১৮)। Islam: A Short History। Random House Publishing Group। আইএসবিএন 978-0-307-43131-8। Armstrong, Karen (২০০৭-১২-১৮)। Islam: A Short History। Random House Publishing Group। আইএসবিএন 978-0-307-43131-8।
- Lings, Martin (২০০৬-১০-০৬)। Muhammad: His Life Based on the Earliest Sources। Inner Traditions/Bear। আইএসবিএন 978-1-86377-153-8। Lings, Martin (২০০৬-১০-০৬)। Muhammad: His Life Based on the Earliest Sources। Inner Traditions/Bear। আইএসবিএন 978-1-86377-153-8। Lings, Martin (২০০৬-১০-০৬)। Muhammad: His Life Based on the Earliest Sources। Inner Traditions/Bear। আইএসবিএন 978-1-86377-153-8।