জাতীয় পতাকা
জাতীয় পতাকা প্রত্যেক দেশের নিজস্ব প্রতীক-স্বরূপ, জাতীয় অনুষ্ঠানে প্রতিটি দেশের মানুষ স্বতন্ত্র জাতীয় পতাকা ব্যবহার করেন। সাধারণ মানুষ, বিদ্যালয়, আদালত সবাই যে কোনো সময় জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে পারে। তবে কিছু কিছু দেশে অসামরিক ভবনে শুধু কিছু নির্দিষ্ট দিনেই ওড়ানো যায়। সুস্পষ্ট তিন ধরনের জাতীয় পতাকা জলে ও স্থলে ব্যবহৃত হয়। যদিও অনেক দেশে একই পতাকা সব ধরনের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়।
স্থলের জাতীয় পতাকা
[সম্পাদনা]স্থলে অসামরিক (FIAV চিহ্ন ), রাষ্ট্রীয় () ও সামরিক বা যুদ্ধ পতাকার () মধ্যে পার্থক্য থাকে। রাষ্ট্রীয় পতাকা সরকারীসংস্থাই শুধু ব্যবহার করতে পারে। আর আসামরিক পতাকা হচ্ছে সবার জন্য। সামরিক পতাকা বা যুদ্ধ পতাকা শুধু সামরিক সংস্থাগুলিই ব্যবহার করতে পারে।
ব্যবহারিক ক্ষেত্রে, বহু দেশই (যেমন, যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্য) একই পতাকা এই তিন ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। জাতীয় পতাকা বলতে কখনো কখনো সেই সব পতাকা গুলিকে বোঝায় যাদের এই তিন ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয় ()। আবার অনেক দেশে, বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে, অসামরিক ও রাষ্ট্রীয় পতাকার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রীয় পতাকার সরলীকৃত রূপ হল অসামরিক পতাকা। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পতাকায় সরকারী সিলমোহর থাকে, যেটা অসামরিক পতাকায় থাকে না।
খুব কম দেশই আলাদা যুদ্ধ পতাকা ব্যবহার করে। উদাহরণ হিসাবে, চীন, তাইওয়ান ও জাপানের নাম করা যায়। আবার ফিলিপাইন্সের আলাদা যুদ্ধকালীন পতাকা না থাকলেও যুদ্ধের সময়, স্বাভাবিক নীল দিক উপরে রাখার বদলে জাতীয় পতাকা উল্টো করে লাল দিক উপরে রাখা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের মত কিছু দেশে, আপতকালীন পরিস্থিতিতে জাতীয় পতাকা উল্টো করে টাঙ্গানোর নিয়ম আছে।
জলের জাতীয় পতাকা
[সম্পাদনা]একটি জাহাজ কোন দেশের তা বোঝাতে এই পতাকা ব্যবহৃত হয়। এখানেও অসামরিক (), রাষ্ট্রীয় ) ও সামরিক পতাকার () বিভাজন আছে। ব্যক্তিগত জলযানে অসামরিক পতাকা, সরকারী জলযানে রাষ্ট্রীয় পতাকা ও যূদ্ধজাহাজে সামরিক পতাকা ব্যবহার হয়। এই পতাকা টাঙানোর জন্য নির্দিষ্ট দন্ড থাকে। এই দন্ড মাস্তুলের থেকে ছোট হলেও তা জাহাজের অন্যান্য পতাকা দন্ডের থেকে উন্নত হয়। বিমানের ক্ষেত্রে এই পতাকা বিমানের গায়ে রং করে আঁকা থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার মত কিছু দেশে জলের জাতীয় পতাকা, স্থলের জাতীয় পতাকার অনুরূপ। আবার যুক্তরাজ্য বা জাপানের মত দেশের ক্ষেত্রে এই দু'ধরনের পতাকা আলাদা। বেশিরভাগ দেশের তিন ধরনের জাতীয় পতাকা আলাদা হয় না, ব্যতিক্রম যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যের জলের অসামরিক পতাকা লাল, সামরিক পতাকা সাদা ও রাষ্ট্রীয় পতাকা নীল রঙের হয়।
অনুরূপ পতাকা
[সম্পাদনা]যদিও কোন দেশের জাতীয় পতাকা সেই দেশের একটি বিশিষ্ট প্রতীক, তাও বিশ্বে এমন অনেক জোড়া দেশ আছে যাদের পতাকার অনেকটাই একই রকম দেখতে; আর তাই সহজেই গুলিয়ে যায়। যেমন মোনাকোর আর ইন্দোনেশিয়ার পতাকা, শুধু পতাকার আকারের অনুপাতের দিক থেকে আলাদা। আবার হল্যান্ডের এবং লুক্সেমবুর্গের পতাকা আকারের অনুপাতে আলাদা তো বটেই, তাছাড়াও পতাকার নীল রঙের গাড়ত্বেও পার্থক্য আছে। আর রোমানিয়া ও চাদের পতাকায় পার্থক্য শুধু পতাকার নীল রঙের গাড়ত্বে।
আবার পতাকার রঙের ব্যবহারে আঞ্চলিক পছন্দ লক্ষ্যনীয়। যেমন, স্লাভ অঞ্চলের দেশগুলির পতাকায় লাল, সাদা ও নীল রং বেশি ব্যবহার হয়েছে। চেক প্রজাতন্ত্র, রাশিয়া, স্লোভেনিয়া, এবং ক্রোয়েশিয়া এই ধারার উদাহরণ। এছাড়াও পশ্চিমী বিশ্বেও এই তিনটি রঙের আধিক্য দেখা যায়; যেমন, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, হল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র। আফ্রিকার দেশগুলি আবার লাল, হলুদ আর সবুজ রং বেশি পছন্দ করে। যেমন, ক্যামেরুন, মালি ও সেনেগাল। আবার আরব দেশগুলির পছন্দ কালো, সাদা ও লাল রং। যেমন, মিশর, ইরাক ও ইয়েমেন।
এই আশ্চর্য্য মিলের কিছু কিছু কাকতালীয় হলেও, কিছু কিছু আবার দেশগুলির একই ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ভেনেজুয়েলা, কলম্বিয়া, আর ইকুয়েডরের পতাকা আসলে গ্রেট কলম্বিয়ার পতাকারই বিভিন্ন রূপ। স্পেন থেকে প্রথমে গ্রেট কলম্বিয়া নামে ঐ ভূখণ্ড স্বাধীনতা লাভ করে; পরে ভেনেজুয়েলার বিখ্যাত স্বাধীনতা যোদ্ধা ফ্রানসিস্কো ডি মিরান্ডার সাহায্যে দেশ তিনটি পৃথক হয়। আবার আরব বিদ্রোহের পতাকার (১৯১৬-১৯১৮) সাথে মিশর, ইরাক, সিরিয়া, ওইয়েমেনের পতাকার মিল লক্ষ্যনীয়। নর্ডিক দেশগুলির (মানে আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, এছাড়া ফারো দ্বীপপুঞ্জ ও আলান্ডের মত স্বশাসিত এলাকা গুলি) পতাকা আবার একই নক্সার। এই নক্সা হল এক রঙের জমির উপর আর এক রঙের " "-চিহ্ন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য উভয়ের পতাকাতেই লাল নীল ও সাদা রং ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম তেরটি রাজ্য যুক্তরাজ্যের প্রাক্তন উপনিবেশ ছিল। আবার অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের পতাকাতেও ব্রিটিশ ঐতিহ্যের কারণে সাযুজ্য লক্ষ্যনীয়। দুদেশের পতাকাতেই ইউনিয়ন জ্যাক আছে এক কোনায়, জমিতে গাঢ় নীল রং, এবং দুদেশের পতাকাতেই সাদার্ন ক্রস ভীষণ ভাবে উপস্থিত।
আরো নানান রকম সাযুজ্যও বিভিন্ন দেশের জাতীয় পতাকায় দেখা যায়। যেমন উল্টো রঙের ব্যবহার যদি ধরা হয় তাহলে আইভরি কোস্ট আর আয়ার্ল্যান্ডের পতাকা এক। আবার প্রাচীন ঐতিহাসিক পতাকা ও আজকের পতাকা ধরলে, আজকের আলবানিয়ার জাতীয় পতাকা আসলে বাইজ্যান্টাইন (পূর্ব রোমান) সাম্রাজ্যের যুদ্ধ পতাকা।
অদ্ভুত পতাকা
[সম্পাদনা]নেপালের জাতীয় পতাকা বিশ্বের একমাত্র পতাকা যা আয়তাকার নয়।
শুধু সুইজারল্যান্ড ও ভ্যাটিকান সিটির পতাকা আবার নিখুঁত বর্গাকার।
লিবিয়ার জাতীয় পতাকায় শুধু একটাই রং সবুজ ব্যবহৃত হয়েছে। না অন্য কোন রং বা না অন্য কোন নক্সা।
আবার সাইপ্রাস, ক্রিসমাস দ্বীপ ও কসোভোর পতাকায় আবার সে দেশের মানচিত্র আঁকা আছে (কোরীয় সংযুক্তিকরণ পতাকায় সমগ্র কোরীয় উপদ্বীপের মানচিত্র আছে যদিও এটি উত্তর কোরিয়া বা দক্ষিণ কোরিয়া কোথাওই সরকারীভাবে স্বীকৃত নয়। আদিতে বাংলাদেশের পতাকায় লাল বৃত্তখণ্ডে হলুদ বর্ণের মানচিত্র ছিল যা পরবর্তী কালে উঠিয়ে দেয়া হয়।
এদিকে মলডোভা, প্যারাগুয়ে আর সৌদি আরবের পতাকা সামনে-পিছনে এক রকম নয়।
মোজাম্বিকের পতাকা হল একমাত্র পতাকা যাতে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের (একটি AK-47) আছে (গুয়াতেমালার পতাকায় যদিও দুটি রাইফেল ব্যবহৃত হয়েছে, তবে সেগুলি ১৮৭১ সালের রেমিংটন রাইফেল[১])।
পতাকা সম্পর্কিত রীতিনীতি
[সম্পাদনা]জাতীয় পতাকা প্রদর্শন সংক্রান্ত অনেক রীতিনীতি আছে। সাধারণভাবে বলা যায় যে কোনো জাতীয় পতাকা সম্মানজনকভাবে প্রদর্শন করতে হবে এবং অন্য কোনো পতাকার তুলনায় কখনোই কোনোরূপ হীন অবস্থানে রাখা যাবে না (যদিও কোনো কোনো দেশে রাজ পতাকার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করা হয়)। স্থলে পতাকা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত নিয়মাবলী পালন করা হয়।
- যখন জাতীয় পতাকা অন্য কোনো পতাকার সাথে ওড়ানো হয়, তখন জাতীয় পতাকাকে সর্বাগ্রে উত্তোলন করতে হবে ও সব শেষে নামাতএ হবে।
- যখন জাতীয় পতাকা অন্য কোনো দেশের জাতীয় পতাকার সাথে ওড়ানো হবে তখন সবার আকার মোটামুটি এক হতে হবে ও সবাইকে একই উচ্চতায় ওড়াতে হবে; যদিও সংগঠক দেশের পতাকার বিশেষ সম্মাণ প্রাপ্য (যদি বিজোড় সংখ্যক পতাকাদন্ড থাকে তাহলে মাঝখানে, অথবা জোড় সংখ্যক পতাকাদন্ডের ক্ষেত্রে ডানপ্রান্তে, মানে দর্শকের দৃষ্টিকোণ থেকে বামদিকে থাকবে)।
- যখন জাতীয় পতাকা অন্য সাধারণ পতাকার সাথে উড়বে তখন জাতীয় পতাকার জন্য আলাদা পতাকাদন্ডে হয় অধিক উচ্চতায় নয়তো সম্মানজনক অবস্থানে রাখতে হবে।
- যদি একান্তই একটি পতাকা দন্ডে অন্যান্য পতাকার সাথে জাতীয় পতাকাকে ওড়াতে হয় তবে অবশ্যই তা সবার উপরে থাকবে।
- যখন জাতীয় পতাকা আড়াআড়ি ভাবে রাখা পতাকাদন্ডে অন্য কোনো পতাকার সাথে ওড়াতে হবে তখন জাতীয় পতাকা দর্শকের বামদিকে ও এর পতাকাদন্ড অন্য পতাকাদন্ডটির সামনে থাকবে।
- যখন জাতীয় পতাকা কোনো মিছিলে বহন করা হবে অন্যান্য পতাকার সাথে তখন জাতীয় পতাকা মিছিলের ডানদিকে থাকবে। আর যদি পতাকা গুলি সারিবদ্ধভাবে বহন করা হয় তখন জাতীয় পতাকাকে সম্মানজনকভাবে বহন করতে হবে।
- যখন কোনো জাতীয় পতাকা উল্টো করে টাঙানো হয় তার মানে হল ভয়ংকর সমস্যা। যদিও এটা একটা প্রথামাত্র। এটার আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংঘর্ষ প্রতিরোধক নিয়মাবলীতে সেভাবে কোনো স্বীকৃতি নেই। তাছাড়া, সাধারণভাবে কোনো দেশের জাতীয় পতাকা উল্টো করে টাঙিয়ে সেই দেশের প্রতি ধিক্কার বা প্রতিবাদ জানানো হয়। এখনো পর্যন্ত্য, শুধু ফিলিপাইন্সে উল্টো করে পতাকা টাঙানো যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বোঝায়।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]- Flag terminology
- Flag desecration
- পতাকা দিবস
- Flags of the World
- Flag protocol
- National emblem
- Coat of arms
- সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের প্রতীকের গ্যালারি
- List of countries
- সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের তালিকা
- Gallery of sovereign-state flags
- Gallery of maritime flags
- পূর্বতন স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের পতাকা
- Flags of active autonomist and secessionist movements
- নির্ভরশীল অঞ্চলসমূহের পতাকা
- Scandinavian Cross
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- Flags of the World, a massive online vexillological database on national and many other kinds of flags
- The World All Countries Flags, a website about national symbols
- World Flag Database reverse search for ID by color and layout
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Guatemala"। Flags of the World। ২০০৮-০৭-২৬। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৩-২৩।
Article 6. The genuine Remington rifles (1871) shall be shown with triangular bayonet