চৌম্বক হিস্টেরেসিস
চৌম্বক হিস্টেরেসিস তখনই ঘটে যখন কোনো ফেরোচৌম্বক পদার্থ যেমনঃ লোহার ওপর কোনো বাহ্যিক চৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করা হয় এবং এটোমিক বা পারমাণবিক দ্বিপোলগুলোও এর সাথে সামঞ্জস্য রাখে। এমনকি চৌম্বক ক্ষেত্রটা সরিয়ে ফেললেও পদার্থটি চৌম্বকায়িত হবার কারণে সেই সামঞ্জস্যতার কিছু অংশ তারপরও থেকে যায়। আর একবার চৌম্বকায়িত হলে, চুম্বকটি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য চৌম্বকায়িত থেকে যাবে। চৌম্বকত্ব দূর করতে, চুম্বকটিতে তাপ কিংবা চৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করতে হবে, তবে এবার পূর্বের দিকের সম্পূর্ণ বিপরীতে প্রয়োগ করতে হবে। এই প্রভাবের সাহায্যেই মূলত কোনো হার্ড ডিস্ক ড্রাইভের মেমোরি প্রদান করা হয়।
সাধারণত পূর্বোক্ত পদার্থগুলোর ক্ষেত্রে, চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রাবল্য H ও চুম্বকত্ব M এর সম্পর্ক রৈখিক হয় না। যদি কোনো চুম্বককে অচৌম্বকায়িত (demagnetized) করা হয় (H=M=0) এবং H ও M এর মাঝের সম্পর্ক স্থাপন করা হয় যাতে প্রাবল্য M বৃদ্ধি পায় তবে প্রারম্ভিক চৌম্বকত্ব লেখচিত্র (initial magnetization curve) পাওয়া যাবে। এই লেখচিত্রটা প্রথমে বৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হলেও পরবর্তীতে একটি অ্যাসিম্পটোটের (asymptote) দিকে অগ্রসর হয় যাকে সম্পৃক্ত চৌম্বকত্ব (magnetic saturation) বলা হয়। যদি চৌম্বক ক্ষেত্রটা একনাগারে কমানো হয়, তবে M ভিন্ন রকম লেখচিত্র প্রদর্শন করে। শূণ্য প্রাবল্যের ক্ষেত্রে, চৌম্বকত্ব তার উৎস থেকে সরে যায় এমন এক পরিমাণে যাকে পুনরাহন (remanence) বলা হয়। যদি H-M এর সম্পর্ক প্রয়োগকৃত চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রাবল্যের জন্য প্লট করা হয়, ফলাফলস্বরূপ একটি হিস্টেরেসিস (hysteresis) লুপ পাওয়া যায় যাকে প্রধান লুপ বলা হয়। H অক্ষ বরাবর মাঝের সেকশনটার প্রস্থ, ফেরোচৌম্বক পদার্থটির বাহ্যিক চৌম্বকক্ষেত্রকে প্রতিরোধ করার সামর্থ্যের (coercivity) দ্বিগুণ হবে। [১](Chapter 1)
চৌম্বকত্বের লেখচিত্রের দিকে আরো ভালভাবে লক্ষ্য করলে, চৌম্বকত্বের ভিতরে কিছু ছোট ও অনিয়মিত পরিবর্তন ( jumps) খুঁজে পাওয়া যায়, যাকে বারখাউসেন জাম্প (Barkhausen jumps) বলা হয়। বিভিন্ন ক্রিস্টালোগ্রাফিক ডিফেক্ট (স্ফটিকের ভেতরের ত্রুটি) যেমনঃ স্থানচ্যুতি বা dislocation এর জন্য এ ধরনের প্রভাব দেখা যায়। [১](Chapter 15)
চৌম্বক হিস্টেরেসিস লুপগুলো উপাদানভেদে ভিন্ন হয়, ফেরোচৌম্বকের ক্রম অনুসারে। অন্যান্য চৌম্বকত্বের ক্রম যেমনঃ স্পিন গ্লাস (spin glass) এর ক্রমের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার পরিলক্ষিত হয়। [২]
ভৌত উৎপত্তি
[সম্পাদনা]ফেরোচৌম্বক জাতীয় পদার্থের ক্ষেত্রে, হিস্টেরেসিস বলতে মূলত দুইটি প্রভাবের ফলাফলকে বুঝানো হয়, প্রভাব দু'টি হলোঃ চৌম্বকত্বের আবর্তন ও চুম্বক ডোমেইন এর সংখ্যা কিংবা আকারের পরিবর্তন । স্বাভাবিকভাবে, কোনো সাধারণ চুম্বকের চৌম্বকত্বের দিক পরিবর্তিত হয়, তবে বিস্তার একই থাকে। কিন্তু খুব বেশি ছোট আকারের চুম্বকের জন্য এ নিয়ম খাটে না। এসব একক ডোমেইন চুম্বকে, এর চুম্বকত্ব চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রতি সাড়া দেয় আবর্তন বা rotation এর মাধ্যমে। একক ডোমেইন চুম্বকগুলো তখনই ব্যবহৃত হয়, যখন কোনো শক্তিশালী ও স্থায়ী চুম্বক তৈরির প্রয়োজন হয় যেমনঃ ম্যাগনেটিক রেকর্ডিং।
বড় চুম্বকগুলো ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত হয়, যাকে ডোমেন বলে। প্রতিটা ডোমেনের ভিতরে চৌম্বকত্বের তেমন তফাৎ থাকেনা, তবে ডোমেইনগুলোর মাঝে বেশ পাতলা দেয়াল থাকে যাকে ডোমেন ওয়াল বলে যার মধ্য দিয়ে এক ডোমেইন থেকে অন্য ডোমেইনের দিকে চৌম্বকত্ব আবর্তিত হয়। চৌম্বক ক্ষেত্রের কোনো রকম পরিবর্তন হলে, দেয়ালগুলো স্থান পরিবর্তন করে আর এতে ডোমেইনগুলোর আপেক্ষিক আকারেরও পরিবর্তন দেখা যায়। যেহেতু ডোমেনগুলো একই দিকে চৌম্বকায়িত হয় না, সেহেতু প্রতি একক আয়তনে চুম্বক ভ্রামক বা চুম্বক মোমেন্ট এর মান একক ডোমেন চুম্বকের তুলনায় কম হয়। কিন্তু ডোমেইন ওয়ালগুলো চৌম্বকত্বের খুব ছোট একটা অংশকে আবর্তনের মাধ্যমে প্রভাবিত করে আর এজন্য চুম্বক মোমেন্টের মানে পরিবর্তন আনাটা বেশ সহজ হয়ে যায়। চৌম্বকত্বের মাঝেও পরিবর্তন আনা যায়- ডোমেইন সংযোগ কিংবা বিয়োজন করে যা যথাক্রমে নিউক্লিয়েশন ও ডি-নিউক্লিয়েশন নামে পরিচিত।
আনুষঙ্গিক মডেল বা ভিত্তির বিবরণ
[সম্পাদনা]হিস্টেরেসিস সম্পর্কিত সবচেয়ে প্রচলিত মডেল হলো প্রিসাচ মডেল (Preisach model) এবং জিলস-আথারটন মডেল (Jiles-Atherton model))। এই মডেলগুলো ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয় কারণ এদের সাহায্যে হিস্টেরেসিস লুপের ব্যপারে যথেষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
কিন্তু এই মডেলগুলো তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারায় তাপগতিবিদ্যা বা থার্মোডায়নামিক্সের ক্ষেত্রে যখন এনার্জির ধারাবাহিকতা অনিশ্চিত থাকে। আরেকটি সাম্প্রতিক মডেলে থার্মোডায়নামিক্সের আরো আধুনিক ভিত্তি যেমনঃ kinematic hardening এর সূত্র ও থার্মোডায়নামিক্সের irreversible process কে বিবেচনা করে প্রকাশ করা হয়েছে। এ মডেলটি ল্যাভেট (Lavet et al.) (2011) -এর Vectorial Incremental Nonconservative Consistent Hysteresis (VINCH) মডেল হিসাবে পরিচিত। [৩] এ মডেলটায় বিশেষ করে সঞ্চিত চৌম্বক শক্তি ও সঞ্চারিত শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। এই ক্রমবর্ধমান ফরমুলাটি আগের চেয়ে অনেক বেশি সামঞ্জস্যপূর্ন যেমনঃ এখানে অন্তর্বর্তী চলক বা ইন্টার্নাল ভ্যারিএবলগুলো থার্মোডায়নামিক পোটেনশিয়াল এর হ্রাসের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। ফলে একটা ভেক্টোরিয়াল মডেল প্রতিষ্ঠিত হলো যেখানে প্রিসাচ মডেল ও জিলস-আথারটন মডেল ছিল শুধুমাত্র স্কেলারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
প্রয়োগ
[সম্পাদনা]চুম্বক জাতীয় উপাদানে হিস্টেরেসিস থিওরির অনেক রকম ব্যবহার দেখা যায়; মেমোরি সংরক্ষণের কাজেই বেশি ব্যবহৃত হয় যেমনঃ ম্যাগনেটিক টেপ, হার্ড ডিস্ক ও ক্রেডিট কার্ড। এসব ব্যবহারের সময়, লোহার মত হার্ড ম্যাগনেটকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় এর উচ্চ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা high coercivity থাকার জন্য। ফলে মেমোরি সহজে মুছে যায় না, বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায়।
যেসব চুম্বক কোমল বা সফট প্রকৃতির ও প্রতিরোধ ক্ষমতা কম (low coercivity), তাদেরকে ট্রান্সফর্মার ও তাড়িতচুম্বক এর core বা মূল উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয়। চৌম্বক ক্ষেত্রের উপর চৌম্বক ভ্রামকের প্রতিক্রিয়া এর চারদিকে বেষ্টিত কয়েলের ক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এমনকি কম প্রতিরোধ ক্ষমতা বা Low coercivity হিস্টেরেসিসের এনার্জি লসকে বেশ খানিকটা কমাতে পারে।
সেই মহাকাশ যুগ (space age) এর শুরু থেকেই স্যাটেলাইটগুলোর পৃথিবীকে আবর্তন (low earth orbit) এর সময় এর কৌণিক গতিকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য চৌম্বক হিস্টেরেসিস প্রদর্শনকারী পদার্থ যেমনঃ নরম নিকেল-লোহা রড ব্যবহার করা হয়। [৪]
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ Chikazumi, Sōshin (১৯৯৭)। Physics of ferromagnetism (2nd সংস্করণ)। Oxford: Oxford University Press। আইএসবিএন 9780191569852।
- ↑ Monod, P.; Prejean, J. J.; Tissier, B. (১৯৭৯)। "Magnetic hysteresis of CuMn in the spin glass state"। J. Appl. Phys.। 50 (B11): 7324। ডিওআই:10.1063/1.326943। বিবকোড:1979JAP....50.7324M।
- ↑ Vincent Francois-Lavet et al (2011-11-14). Vectorial Incremental Nonconservative Consistent Hysteresis model.
- ↑ "Magnetic Hysteresis Damping of Satellite Attitude Motion" (পিডিএফ)। General Electric Spacecraft Department। ২ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ অক্টোবর ২০১৬।