কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যানের ভূপ্রকৃতি
কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যান (Assamese: কাজিৰঙা ৰাষ্ট্ৰীয় উদ্যান, Kazirônga Rastriyô Uddyan) ভারতের আসাম রাজ্যে নগাঁও ও গোলাঘাট জেলায় অবস্থিত একটি বিখ্যাত জাতীয় উদ্যান। এশীয় একশৃঙ্গ গণ্ডারের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল কাজিরাঙ্গা ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটি।[১] ১৯০৫ সালে একে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিশ্বের অন্যসব সংরক্ষিত অঞ্চলের তুলনায় কাজিরঙ্গাতে বাঘের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। ২০০৬ সালে কাজিরঙ্গাকে ব্যাঘ্র সংরক্ষণ ক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই উদ্যান এশীয় হাতি, বুনো মহিষ ও বারশিঙ্গার এক বৃহৎ প্রজনন ক্ষেত্র।[২] অসংখ্য পাখি প্রজাতির অনন্য সমাবেশস্থল বলে বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল কাজিরাঙ্গাকে গুরুত্বপূর্ণ পক্ষীক্ষেত্র (Important Bird Area) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
কাজিরাঙ্গা লম্বা শন (Miscanthus sinensis), জলাভূমি ও ঘন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও অর্ধ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রশস্তপত্রী বৃক্ষের অরণ্যে পরিপূর্ণ। ব্রহ্মপুত্র নদ, ডিফলু নদী, মরা ডিফলু নদী ও মরা ধানসিঁড়ি নদী, এই চারটি প্রধান নদী এর মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে। পুরো উদ্যানে অসংখ্য ছোট-বড় বিল রয়েছে। ২০০৫ সালে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যানের শতবর্ষপূর্তি উদযাপিত হয়।
ভূপ্রকৃতি
[সম্পাদনা]কাজিরাঙ্গা ২৬°৩০' উত্তর থেকে ২৬°৪৫' উত্তর অক্ষরেখা এবং ৯৩°০৮' পূর্ব থেকে ৯৩°৩৬' পূর্ব দ্রাঘিমারেখার মধ্যে অবস্থিত। আসামের কালিয়াবর মহকুমার নগাঁও জেলা ও বোকাখাট মহকুমার গোলাঘাট জেলা, এই দুই জেলা জুড়ে কাজিরঙ্গা জাতীয় উদ্যান বিস্তৃত।[৩] উদ্যানটির দৈর্ঘ্য পূর্ব পশ্চিমে প্রায় ৪০ কিলোমিটার (২৫ মাইল) এবং উত্তর দক্ষিণে ১৩ কিলোমিটার (৮ মাইল)।[৪] কাজিরাঙ্গার মোট আয়তন বর্তমানে ৩৭৮ বর্গকিলোমিটার (১৪৬ বর্গ মাইল)। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর মোট ৫১.১৪ বর্গ কিলোমিটার (১৪৬ বর্গ মাইল) ভূমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।[৪] সব মিলিয়ে মোট ৪২৯ বর্গ কিলোমিটার (১৬৬ বর্গ মাইল) এলাকা কাজিরঙ্গা জাতীয় উদ্যানের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। পুরো এলাকাটি বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ আবাস ও প্রজননস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া কাজিরাঙ্গা কার্বি আংলং পাহাড়ে বন্যপ্রাণীদের চলাচলের একটি নিরাপদ পথ হিসেবে হিসেবে বহু আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।[৫] সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কাজিরাঙ্গার উচ্চতা ৪০ মিটার থেকে ৮০ মিটার পর্যন্ত। এর সর্বোচ্চ এলাকাটি হচ্ছে দক্ষিণের মিকির পাহাড়, এর উচ্চতা ১২২০ মিটার (৪০০৩ ফুট)।[৩] উদ্যানের পুরো উত্তর ও পূর্ব সীমা জুড়ে ব্রহ্মপুত্র নদ বিস্তৃত রয়েছে। আর দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে মরা ডিফলু নদী। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নদীর মধ্যে ডিফলু ও মরা ধানসিঁড়ি নদী অন্যতম।[৫]
কাজিরাঙ্গার ভূমি উর্বর পলিমাটি দ্বারা আবৃত। শত শত বছর ধরে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে এবং এর প্রবাহিত পলি জমে কাজিরাঙ্গার ভূমি সৃষ্টি হয়েছে। অসংখ্য চর রয়েছে এখানে। আরও রয়েছে বন্যাবাহিত বিস্তীর্ণ জলাশয়। এসব জলাশয় বিল নামে পরিচিত। কাজিরাঙ্গার মোট এলাকার পাঁচ শতাংশ দখল করে আছে এসব বিল। এছাড়াও কিছু উচ্চভূমি রয়েছে যেগুলোকে স্থানীয়ভাবে চাপরি বলা হয়। বন্যার সময় পশুপাখি এসব চাপরিতে এসে আশ্রয় নেয়। বন্যার সময়ে প্রাণীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় বহু কৃত্রিম চাপরি সৃষ্টি করা হয়েছে।[৬][৭]
ভূমিরূপ
[সম্পাদনা]শত শত বছর ধরে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙন ও পলি জমে কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যানের ভূমিরূপ সৃষ্টি হয়েছে। বর্ষাকালে বন্যার সময় ভাঙন ও পলি জমার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ৭২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্রহ্মপুত্র নদ প্রবাহিত হওয়ার সময় তার দু'পাশের পাহাড়ি এলাকার অসংখ্য অসংখ্য জলপ্রবাহের সাথে মিলিত হয়। এসব জলপ্রবাহ যে মাটি বয়ে নিয়ে আসে, তা ব্রহ্মপুত্র বয়ে নিয়ে চলে এবং ভাটির দিকে আসাম ও বাংলাদেশের সমতল এলাকায় এসে জমা হয়। বন্যার সময়ে সৃষ্ট অতিরিক্ত পানি বহনের জন্য ব্রহ্মপুত্রের যে শাখাগুলোর সৃষ্টি হয়, সেগুলো বন্যার পরে স্তিমিত হয়ে অসংখ্য ছোট-বড় বাঁওড় ও বিলের সৃষ্টি করে।
বনভূমি
[সম্পাদনা]পূর্ব হিমালয় জীববৈচিত্র্য হটস্পটে (biodiversity hotspot) উদ্যানটির অবস্থান হওয়ায় বিবিধ প্রজাতির অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর দর্শন পাওয়া যায় এখানে।[৮]
কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যান ইন্দোমালয় ইকোজোনের অন্তর্ভুক্ত। এর প্রধান প্রধান পরিবেশসমূহের মধ্যে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও অর্ধ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রশস্তপত্রী বৃক্ষের বনভূমির অন্তর্গত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অর্ধ-চিরসবুজ অরণ্য এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও অর্ধগ্রীষ্মমণ্ডলীয় তৃণভূমি, সাভানা ও গুল্মভূমির অন্তর্গত তেরাই-ডুয়ার সাভানা ও তৃণভূমি অন্যতম।
মানব বসতি
[সম্পাদনা]কাজিরাঙ্গার সীমানার মধ্যে কোন মানব বসতি নেই। তবে উদ্যানের বাইরে জনবসতি বেশ ঘন। ১৯৮৩-৮৪ সালের হিসাব অনুযায়ী উদ্যানের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে মোট ৩৯টি গ্রাম রয়েছে এবংএ গ্রামগুলোতে মোট জনসংখ্যা ২২,৩০০।[৩] ২০০২ সালে গ্রামের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮৪টি যাতে প্রায় ৫০,০০০ ঘর রয়েছে।[৫] পর্যটন শিল্পের দ্রুত প্রসারের ফলে কাজিরাঙ্গার ঠিক সীমানাতে কিছু জনবসতির সৃষ্টি হয়েছে।[৫]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Bhaumik, Subir (১৭ এপ্রিল ২০০৭)। "Assam rhino poaching 'spirals'"। BBC News। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৮-২৩।
- ↑ "Welcome to Kaziranga"। ৩০ এপ্রিল ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ আগস্ট ২০১২।
- ↑ ক খ গ "UN Kaziranga Factsheet"। UNESCO। ২০০৭-০৭-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৩।
- ↑ ক খ Lahan, P; Sonowal, R. (মার্চ ১৯৭২)। "Kaziranga WildLife Sanctuary, Assam. A brief description and report on the census of large animals"। Journal of the Bombay Natural History Society। 70 (2): 245–277।
- ↑ ক খ গ ঘ :pp. ২০–২১Mathur, V.B.। "UNESCO EoH Project_South Asia Technical Report–Kaziranga National Park" (পিডিএফ)। UNESCO। ২০০৮-০৫-৩০ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৮-২৩। অজানা প্যারামিটার
|coauthors=
উপেক্ষা করা হয়েছে (|author=
ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য) - ↑ "Kaziranga National Park"। ২০০৬-০৫-০১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-০৫-০১।. WildPhotoToursIndia(Through Archive.org). Retrieved on 2007-02-27
- ↑ :p.০৩ "State of Conservation of the World Heritage Properties in the Asia-Pacific Region –Kaziranga National Park" (PDF)। UNESCO। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০৮-২৩।
- ↑ Phatarphekar, Pramila N. (২০০৫-০২-১৪)। "Horn of Plenty"। Outlook India। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০২-২৬।