আবদুল্লাহ আল-বাত্তাল
আবদুল্লাহ আল-বাত্তাল | |
---|---|
স্থানীয় নাম | عبدالله البطال |
মৃত্যু | ৭৪০ খ্রিষ্টাব্দ এক্রোইনন |
আনুগত্য | উমাইয়া খিলাফত |
কার্যকাল | ৭২৭-৭৪০ খ্রিষ্টাব্দ |
যুদ্ধ | আরব-বাইজেন্টাইন যুদ্ধ |
আবদুল্লাহ আল-বাত্তাল (আরবি: عبدالله البطال; মৃত্যু ৭৪০ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন ৮ম শতাব্দীর প্রথমদিকে আরব-বাইজেন্টাইন যুদ্ধের একজন মুসলিম যোদ্ধা। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে উমাইয়া খিলাফতের অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। তার জীবন সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্য দুর্লভ। তবে তার মৃত্যুর পর তার সম্পর্কে কিংবদন্তি গড়ে উঠে। তিনি আরব ও পরবর্তীকালে তুর্কি মহাকাব্যিক সাহিত্য যেমন সাইয়িদ বাত্তাল গাজিতে বিখ্যাত চরিত্র হয়ে উঠেন।
জীবনী
[সম্পাদনা]আবদুল্লাহ আল-বাত্তালের শৈশব বা প্রথম জীবন নিয়ে কিছু জানা যায় না। অনেক পরের বিবরণে তাকে এন্টিওক বা দামেস্কের ব্যক্তি বলে দাবি করা হয়। তার কয়েকটি কুনিয়াত রয়েছে যেমন আবু মুহাম্মদ, আবু ইয়াহিয়া বা আবুল হাসান। শেষোক্তটি দ্বারা তাকে সাধারণত সম্বোধন করা হয়।[১][২] তার নিসবা আল-আনতাকি ("এন্টিওক থেকে")। এটি গোত্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত না হওয়ায় তিনি আরব নন বলে অভিমত রয়েছে। ধারণা করা হয় যে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং এরপর তার নাম আবদুল্লাহ ("আল্লাহর দাস") রাখা হয়। এই নামটি তৎকালীন নতুন ইসলাম গ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত।[২] খালিদ ইয়াহিয়া ব্লানকিনশিপের অভিমত হল ৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে নাইসিয়া অভিযানের সময় বাইজেন্টাইন লেখক থিওফানস দ্য কনফেসারের লিপিবদ্ধ করা "আমর" নামের ব্যক্তি আর আবদুল্লাহ আল-বাত্তাল একই ছিলেন এবং এমন হতে পারে যে তার আসল নাম আমর ও পুরো নাম আমর ইবনে আবদুল্লাহ অথবা তার আসল নাম ছিল আবদুল্লাহ ইবনে আমর এবং পরে তিনি শুধু আবদুল্লাহ বলে পরিচিতি পান।[৩]
আল-ইয়াকুবি ও আল-তাবারির ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, আল-বাত্তাল প্রথম ৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে বাইজেন্টাইন এশিয়া মাইনরের বিরুদ্ধে বার্ষিক অভিযানের সময় আবির্ভূত হন। এই অভিযানে তৎকালীন খলিফা হিশাম ইবনে আবদুল মালিকের পুত্র মুয়াবিয়া ইবনে হিশাম নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আল-বাত্তাল সেনাবাহিনীর সম্মুখভাগের নেতৃত্ব দেন। তাদের নিয়ে তিনি পাফলাগোনিয়ার চানকিরি শহরে আক্রমণ করেন। এরপর তার বাহিনী নাইসিয়া আক্রমণ করে। তবে এই আক্রমণ ব্যর্থ হয়।[১][৪] ব্লানকিনশিপের মতানুযায়ী আল-বাত্তালের চানকিরি জয় এই যুগে বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে উমাইয়াদের একটি বৃহৎ সাফল্য। একই সময়ের অণুরূপ আরেকটি সাফল্য ছিল ৭২৬ খ্রিষ্টাব্দে মাসলামা ইবনে আবদুল মালিক কর্তৃক কাইসারিয়া জয়।[৫] ১০ম শতাব্দীর সূত্র অনুযায়ী আবদুল্লাহ ইবনে বাত্তাল ও মাসলামা ইবনে আবদুল মালিক ৭১৭-৭১৮ খ্রিষ্টাব্দে কনস্টান্টিনোপল অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। তবে আরব বিবরণগুলো এই বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য না থাকায় এই তথ্য সঠিক কিনা তা নিশ্চিত না।[১]
আল-বাত্তাল ৭৩১-৭৩২ খ্রিষ্টাব্দে আরেকটি অভিযান চালান। এ বিষয়ে তেমন কিছু জানা যায় না। ধারণা করা হয় যে, এই অভিযান ব্যর্থ হয়। তবে আরেকজন আরব বীর আবদুল ওয়াহাব ইবনে বুখতের মৃত্যুর কারণে এই অভিযান স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।[১][৬] পরের বছর ১১৫ হিজরিতে আল-বাত্তাল মুয়াবিয়া ইবনে হিশামের সাথে অভিযানে যান এবং এক্রোইনন ফ্রিজিয়া পর্যন্ত প্রবেশ করেন। কনস্টান্টাইন নামক একজনের অধীনে বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনী মুসলিমদের বাধাদানের চেষ্টা করে। তবে আল-বাত্তাল তাকে পরাজিত ও বন্দী করেন।[১][৬][৭] আল-বাত্তালকে সর্বশেষ ৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে বাইজেন্টিয়ামের বিরুদ্ধে উমাইয়া অভিযানের সময় দেখা যায়। এতে প্রায় দশ হাজার থেকে এক লক্ষ সৈনিক অংশ নেয়। মালাতিয়ার ডেপুটি গভর্নর মালিক ইবনে শুয়াইবের সাথে আবদুল্লাহ আল-বাত্তাল এতে অংশ নেন। আবদুল্লাহর অধীনে এতে বিশ হাজার ঘোড়সওয়ার ছিল। মূল সেনাদলের নেতৃত্বে থাকা সুলাইমান ইবনে হিশাম তাদের পেছনে অবস্থান নিয়েছিলেন। আল-বাত্তাল ও মালিকের বাহিনী এক্রোইনন পর্যন্ত পৌছায়। এখানে সংঘটিত এক্রোইননের যুদ্ধে তারা পরাজিত হন। বাইজেন্টাইনদের পক্ষে সম্রাট তৃতীয় লিও ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। উভয় সেনাপতি যুদ্ধে নিহত হন এবং আরব বাহিনীর দুই তৃতীয়াংশ এতে ধ্বংস হয়।[১][৭][৮]
কিংবদন্তি
[সম্পাদনা]আবদুল্লাহ আল-বাত্তালের সামরিক জীবন খুব বেশি জানা না গেলেও তিনি অনেক জনপ্রিয় গল্পের চরিত্র হয় উঠেন এবং তার খ্যাতি বৃদ্ধি পায়। ১০ম শতাব্দী নাগাদ তিনি আরব-বাইজেন্টাইন যুদ্ধের একজন বীর হিসেবে পরিগণিত হন। আল-মাসুদি তাকে সম্মানার্থে বাইজেন্টাইন গির্জায় "চিত্রায়িত মুসলিম ব্যক্তি"দের অন্যতম বলে উল্লেখ করেছেন।[১] কনস্টান্টিনোপল অবরোধে তার অংশগ্রহণ ১০ম-১২শ শতাব্দীতে পারস্যের ইতিহাসবিদ বালামি ও আন্দালুসের সুফি ইবনে আরাবি কর্তৃক আদৃত হয়েছে।[১] ইবনে আসাকিরের (১১০৬-১১৭৫) সময় থেকে আবদুল্লাহ আল-বাত্তাল সম্পর্কিত ঐতিহাসিক তথ্যের সাথে বিভিন্ন গল্প যুক্ত হয়েছে। বাইজেন্টাইনরা তাদের সন্তানদের ভয় দেখাতে এই নাম ব্যবহার করত। এমোরিয়ামে দূতের ছদ্মবেশে তার প্রবেশ, বাইজেন্টাইন পরিকল্পনা উদ্ঘাটন, একটি মঠে আশ্রয় গ্রহণ, মঠের সন্ন্যাসিনী কর্তৃক বাইজেন্টাইন সৈনিকদের কাছ থেকে তাকে রক্ষা, পরে আবদুল্লাহ আল-বাত্তালের সাথে সন্ন্যাসিনীর প্রস্থান ও বিয়ে, শেষে যুদ্ধে মৃত্যু ও দাফনের সময় সম্রাট লিওয়ের উপস্থিতি এমন কাহিনী প্রচলিত ছিল।[১] অন্যদিকে আবদুল্লাহ আল-বাত্তালের সম্পর্কে বিভিন্ন কাল্পনিক ঘটনাগুলো অনেকে সমালোচনা করেছেন। ইবনে কাসির একে "অপরিপক্কদের জন্য উপযুক্ত এমন দুর্বল ও সন্দেহজনক বিষয়বস্তু" বলে গণ্য করতেন।[২]
আল-বাত্তালের কীর্তিকলাপ দুইটি বীরকাহিনীর উপজীব্য হয়েছে। এগুলো হল আরবি সিরাত দাত আল-হিমা ওয়া আল-বাত্তাল ("দিলহিমা ও আল-বাত্তালের গল্প") এবং তুর্কি মহাকাব্যিক সাইয়িদ বাত্তাল গাজি[১] এই দুইটি রচনা ১২শ শতাব্দীতে সম্পাদিত এবং একই আরবি উৎস থেকে আগত হলেও এদের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। তুর্কি গল্পে তুর্কীয় ও পারস্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এতে শাহনামা ও আবু মুসলিমের গল্প থেকে বিভিন্ন অতিপ্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে।[৯] দুইটি গল্পের পটভূমি ৯ম শতাব্দীর মধ্যভাগ। এতে মালাতিয়া ও এর আমির উমর আল-আকতার সাথে তাকে সম্পর্কিত করা হয়েছে।[৯][১০] দিলহামা গল্পে বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বনু কিলাবের বীর আল-সাহসাহ তার স্থান নিয়েছেন। এসব গল্পে আল-বাত্তালকে অডিসিউসের সমকক্ষ মুসলিম ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।[১১] ১১০২ খ্রিষ্টাব্দে মালাতিয়ার দানিশমেন্দ বিজয়ের পর তুর্কিরা আল-বাত্তালকে গ্রহণ করে এবং তিনি তুর্কি জাতীয় বীর ও এশিয়া মাইনর বিজয়ের প্রতীকে পরিণত হন। তার উপর রচিত গল্পগুলো (বাত্তালনামা) পুরো সেলজুক ও উসমানীয় যুগব্যাপী সম্পাদিত হয়েছে। লোককাহিনীতে তিনি একজন উল্লেখযোগ্য চরিত্র।[৯][১২] একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী (বিশেষত আলেভি ও বেকতাশি গোষ্ঠীর মধ্যে) তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে। সেয়িতগাজিতে তার আনুমানিক সমাধি একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থানে পরিণত হয়। ২০শ শতাব্দীতেও সুদূর মধ্য এশিয়া থেকে তীর্থযাত্রীরা এখানে আসত।[৯][১৩]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ Canard (1986), pp. 1002–1003
- ↑ ক খ গ Athamina (2011)
- ↑ Blankinship (1994), p. 314 (Note 20)
- ↑ Blankinship (1994), p. 120
- ↑ Blankinship (1994), pp. 120–121
- ↑ ক খ Blankinship (1994), p. 162
- ↑ ক খ Winkelmann, Lilie, et al. (1999), pp. 5–6
- ↑ Blankinship (1994), pp. 169–170
- ↑ ক খ গ ঘ Melikoff (1986), pp. 1003–1004
- ↑ Dedes (1996), pp. 9–14
- ↑ Canard (1961), pp. 158–173, esp. 167–169
- ↑ Dedes (1996), pp. 9–16, 23–25
- ↑ Dedes (1996), pp. 16–22
উৎস
[সম্পাদনা]- Athamina, Khalil (২০১১)। "al-Baṭṭāl, ʿAbdallāh"। Fleet, Kate; Krämer, Gudrun; Matringe, Denis; Nawas, John; Rowson, Everett। Encyclopaedia of Islam, 3rd Edition। Brill Online। সংগ্রহের তারিখ ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫।
- Blankinship, Khalid Yahya (১৯৯৪)। The End of the Jihâd State: The Reign of Hishām ibn ʻAbd al-Malik and the Collapse of the Umayyads। State University of New York Press। আইএসবিএন 978-0-7914-1827-7।
- Canard, Marius (১৯৬১)। "Les principaux personnages du roman de chevalerie arabe Ḏāt al-Himma wa-l-baṭṭāl"। Arabica. Journal of Arabic and Islamic studies (French ভাষায়)। 8: 158–173। আইএসএসএন 0570-5398।
- Canard, Marius (১৯৮৬)। "al-Baṭṭāl, ʿAbd Allāh"। The Encyclopedia of Islam, New Edition, Volume I: A–B। Leiden and New York: BRILL। পৃষ্ঠা 1002–1003। আইএসবিএন 90-04-08114-3।
- Dedes, Georgios (১৯৯৬)। The Battalname, an Ottoman Turkish Frontier Epic Wondertale: Introduction, Turkish Transcription, English Translation and Commentary (পিডিএফ)। Sources of Oriental Languages and Literatures। Cambridge, MA: Harvard University, Department of Near Eastern languages and Literatures।
- Melikoff, I. (১৯৮৬)। "al-Baṭṭāl (Sayyid Baṭṭāl Ghāzī)"। The Encyclopedia of Islam, New Edition, Volume I: A–B। Leiden and New York: BRILL। পৃষ্ঠা 1003–1004। আইএসবিএন 90-04-08114-3।
- Winkelmann, Friedhelm; Lilie, Ralph-Johannes; ও অন্যান্য (১৯৯৯)। "'Abdallāh al-Baṭṭāl (#15)"। Prosopographie der Mittelbyzantinischen Zeit: I. Abteilung (641–867), 1. Band (German ভাষায়)। Berlin, Germany and New York, New York: Walter de Gruyter। পৃষ্ঠা 5–6। আইএসবিএন 3-11-015179-0।