সুকুমার বসু
সুকুমার বসু (১২ মে ১৯১২ - ১০ নভেম্বর ১৯৮৬) ছিলেন বঙ্গীয় শিল্পরীতিতে অসিত কুমার হালদারের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষিত ভারতীয় চিত্রশিল্পী।
সুকুমার বসু | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ১০ নভেম্বর ১৯৮৬ | (বয়স ৭৪)
জাতীয়তা | ভারতীয় |
দাম্পত্য সঙ্গী | বেলা বসু (চৌধুরী) (বি.১৯৩৬) |
সন্তান | কমল, অতুল ও দেবাশিস (পুত্র) |
পুরস্কার | পদ্মশ্রী (১৯৭০) |
ওয়েবসাইট | https://www.sukumarbose.org |
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
সম্পাদনাসুকুমার বসু ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন আগ্রা ও অবধের যুক্তপ্রদেশের অধুনা উত্তরপ্রদেশের লখনউ-এ জন্মগ্রহণ। পিতা সনৎ কুমার বসু, মাতা বীণাপাণি বসু। পিতামহ বিনোদবিহারী বসু ছিলেন লখনউ আদালতের আইনজীবী ও সুভাষচন্দ্র বসুর আত্মীয়। ব্রাহ্মসমাজ ভুক্ত লখনউ-এর বসু পরিবার লখনউ-এ বাংলার শিল্প ও সংস্কৃতির প্রচারে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল।
বালক সুকুমারের ছোটবেলা থেকেই কাদামাটি ও কাঠের নানান মডেল তৈরিতে আগ্রহ ছিল। তার সেই আগ্রহ সময়ের সাথে চারুকলা - বিশেষ করে চিত্রকলা এবং ভাস্কর্যের প্রতি একটি আবেগে পরিণত হয়।
১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে অসিত কুমার হালদার লখনউ-এর গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্টস এর প্রধান নিযুক্ত হলে, তিনি বসু পরিবারের ঘনিষ্ঠ হন। অসিত কুমার হালদারের পরামর্শে সুকুমার লখনউ-এর সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি হন এবং তারই তত্ত্বাবধানে শিল্পকলা নিয়ে অধ্যয়ন করেন এবং স্নাতক হন। তবে স্নাতক হওয়ার পূর্বেই তার শিল্পকর্ম 'শ্যাডো অফ ডেথ' প্রদর্শনীতে প্রশংসিত হয় এবং আর্ট স্কুলের ছাত্রের সেরা কাজ হিসাবে বিবেচিত হয়। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে মহীশূরের এক প্রদর্শনীতে মিস্টি মর্নিং মেরিট শংসাপত্র লাভ করেন।
কর্মজীবন
সম্পাদনা১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের কুড়ি বৎসর বয়সে, সুকুমার বসু দিল্লির মডার্ন হাই স্কুলে শিল্প শিক্ষক নিযুক্ত হন এবং ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ওই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। সুকুমার বসু সারদা উকিল সহ তাঁর পূর্বসূরিদের সঙ্গে, উত্তর ভারতে বেঙ্গল আর্ট স্কুলের শিল্প ঐতিহ্য ও শৈলী প্রবর্তনের জন্য কৃতিত্ব অর্জন করেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনের করিডোর এবং দেয়ালে তার আঁকা নানা ম্যুরাল এবং ফ্রেস্কোর জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন।[১]
সুকুমার বসু তার শিল্পী জীবনে সক্রিয়ভাবে ভারতীয় শিল্প ও সংস্কৃতির প্রচারে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি 'অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্টস সোসাইটি' র (এআইএফএসিএস) একজন বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন। প্রসঙ্গত, এআইএফএসিএস পরবর্তীতে ভারত সরকারের ললিত কলা একাডেমিতে পরিণত হয়। তিনি এআইএফএসিএস-এর একজন সক্রিয় সদস্য হিসাবে আর্টসের দ্বি-বার্ষিক পত্রিকা রূপ লেখা-র প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সুকুমার বসু দেশের শিল্পকলার সঙ্গে যুক্ত নানা সংস্থার সদস্য ছিলেন-
- গভর্নিং কাউন্সিল, অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস সোসাইটি;
- আর্মি হেডকোয়ার্টার ড্রামাটিক সোসাইটি, নয়াদিল্লি;
- কারিগরি শিক্ষা পর্ষদ, দিল্লি
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে, সুকুমার বসুকে খ্রিস্টধর্মীয় বিষয়ের উপর ভারতীয় শৈলীতে শিল্পকর্ম তৈরির জন্য তৎকালীন ক্যাথলিক চার্চের প্রধান, শ্রদ্ধেয় পোপ পিয়াস দ্বাদশ দ্বারা কমিশন দেওয়া হয়েছিল। তার তৈরি "দ্য নেটিভিটি - দ্য বার্থ অফ ক্রাইস্ট" ভ্যাটিকানে রক্ষিত আছে।
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যুক্তরাজ্য , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং পূর্বতন ইউএসএসআর সহ সারা ভারতবর্ষের নানা শহরে তার শিল্পকর্মের অসংখ্য একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছে।
পুরস্কার ও সম্মাননা
সম্পাদনা- ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাকির হোসেন তার শিল্পকর্মের জন্য তাকে "সিলভার শিল্ড" প্রদান করেন।
- ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার তার শিল্পকলায় অবদানের জন্য দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রী প্রদান করে।
- ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে অবসরের পর তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বরাহগিরি ভেঙ্কট গিরির সাম্মানিক শিল্প উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। এবং[২] ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
শিল্পকর্ম
সম্পাদনাসুকুমার বসুর শিল্পকর্মের শৈলীকে ইন্দো-ফার্সি সংস্কৃতির হিসাবে বর্ণনা করা যায়। তিনি কালো, লাল, সোনালী এবং রূপালীর মতো ঘন রং ব্যবহার করেছেন, তবে যেন আলতো ছোঁয়ায়। সুকুমার বেশ কয়েকটি ম্যুরাল এবং ফ্রেস্কো এঁকেছেন। তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দেয়ালচিত্রের কয়েকটি রাষ্ট্রপতি ভবনে শোভিত আছে। [৩]
তার প্রতিটি কাজই ছিল রূপ, ছন্দ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শ্রমসাধ্য অধ্যয়ন। উড়তে থাকা পাখি, প্রাণী, গাছপালা, ফুল, পাহাড়, কুয়াশা এবং মেঘ এবং মানুষ তার চিত্রকর্মে জীবন্ত হয়ে ওঠে, তাদের নিজের নিজের শক্তিগুলি সূক্ষ্মভাবে স্পন্দিত এবং অনুরণিত হয়।
তিনি ভারতীয় পৌরাণিক মোটিফ, ল্যান্ডস্কেপ, প্রতিকৃতি এবং গ্রামীণ জীবন এবং প্রাণীদের অধ্যয়নের মতো বিভিন্ন বিষয় নিয়েও কাজ করেছেন। তার ল্যান্ডস্কেপের সংগ্রহকে তার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বলে বর্ণনা করা যায় কেননা তারা এমন একজন মানুষকে অন্তর্দৃষ্টি দেয় যিনি প্রকৃতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হয় এবং তার চারপাশের বিশ্ব সম্পর্কে তীব্রভাবে সচেতনতা অনুভব করে।
সুকুমার বসু পুরানো এবং নতুন রীতির মিশ্রনে আধুনিক শিল্প সৃষ্টিতে উদ্যোগী হন। তবে তিনি সর্বদা বাস্তববাদের একাডেমিক এবং শাস্ত্রীয় নীতিগুলি মেনে চলেন। ভারতীয় শিল্প ঐতিহ্যের প্রবক্তা তিনি বিমূর্ত শৈলীর চেয়ে বাস্তববাদকে পছন্দ করতেন। 'দ্য বম্বে ক্রনিকল' স্বাভাবিক ভাবেই তাকে একজন "বহুমুখী শিল্পী" হিসাবে বর্ণনা করে। [৪]
পারিবারিক জীবন ও জীবনাবসান
সম্পাদনাবাইশ বৎসর বয়সে পিতৃহারা হয়ে সুকুমার বসু পরিবারের সমস্ত ভার বহন করেন এবং সরল সাদাসিধে জীবন অতিবাহিত করেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে বেলা চৌধুরীকে বিবাহ করেন। তাদের তিন পুত্রেরা- কমল, অতুল ও দেবাশিস। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর দিল্লিতে প্রয়াত হন।
বহুমুখীশিল্পী সুকুমার বসুর জন্ম শতবর্ষ স্মরণে তার পারিবারিক ট্রাস্টের উদ্যোগে ভেঙ্কা পুরুষোত্তোমনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দ্য আর্ট অফ সুকুমার বোস: রিফ্লেকশনস্ অন সাউথ অ্যান্ড সাউথ-ইষ্ট এশিয়া শীর্ষক একটি গ্রন্থ। গ্রন্থটিতে শিল্পীর ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শিল্প প্রযোজনার প্রেক্ষাপট আলোচনাসহ বিশিষ্ট লেখক, পণ্ডিত এবং ব্যক্তিগত বন্ধুদের রচনা সম্বলিত হয়েছে। [৫]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনাবহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- স্বাধীন ভারতে খ্রিস্টান টাস্ক । Aiyadurai Jesudasen Appasamy, SPCK 1951 (ISBN অনুপলব্ধ), পৃষ্ঠা149: "আমি এই যুবককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে দেশের সেবার জন্য তার আদর্শ কী ছিল, এবং তিনি আমাকে বলেছিলেন, "আপনি জওহরলাল নেহরুর লেখা জানেন। তাঁর আদর্শই আমাদের আদর্শ এবং আমরা তাঁর চেতনাকে অনুকরণ করতে চাই। শিল্পের রাজ্যে, সুকুমার বসু"।
- একটি স্বপ্নকে পঁচাত্তর বছর করে । কৌশবন্ত সিং এবং সৈয়দা এস হামিদ, অ্যালাইড পাবলিশার্স লিমিটেড,আইএসবিএন ৮১-৭০২৩-৪৯৯-৯ । "টাইম'স উইংড রথ", পৃষ্ঠা 65: "ধর্ম হলের উদ্বোধন করেছেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দেয়ালে ফ্রেস্কোতে দেখানো হয়েছে যে সমস্ত ধর্ম ও জাতীয়তার নারী-পুরুষ "সত্যের আলোর দিকে যাচ্ছে"। শিল্পী হলেন সুকুমার বসু। স্কুল অফ আর্ট ডিপার্টমেন্টে ছাত্রদের ব্রাউজ করার জন্য সেখানে রাখা হয় একটি মেডিটেশন রুম।"
- একটি স্বপ্নকে পঁচাত্তর বছর করে । কৌশবন্ত সিং এবং সৈয়দা সাইয়িদিন হামিদ, অ্যালাইড পাবলিশার্স লিমিটেড,আইএসবিএন ৮১-৭০২৩-৪৯৯-৯ । গীতা কাপুরের "দ্য এনচান্টেড স্টুডিও", পৃষ্ঠা 113: "এরপর সুকুমার বসু এসেছিলেন, একই বংশের অসিত কুমার হালদার এবং বিশ্বনাথ মুখার্জির একজন আধিকারিক। এখানে বেঙ্গল স্কুলের পাশাপাশি শান্তিনিকেতন সম্পূর্ণ পরিমাপে এই দিল্লি হাই স্কুলে আমদানি করা হয়েছিল। এটি একটি উত্তরাধিকার ছিল যা শিল্পে একটি জাতীয় শৈলীর বানান ছিল, যা প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি প্রধান প্রতিষ্ঠানে প্রচারিত হয়েছিল।
- ললিত কালা সমসাময়িক। ললিত কলা একাডেমী, 1972
- রূপ লেখা । অল ইন্ডিয়ান ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস সোসাইটি, 1979
- দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া ডিরেক্টরি এবং ইয়ার বুক সহ হু'স হু, 1974
- হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, 28 ফেব্রুয়ারী 1952: "এস বোসের আঁকা ছবি; আর্মি হেডকিউ ড্রামা সোসাইটি দ্বারা স্পনসর করা প্রদর্শনী"
- দ্য স্টেটসম্যান, 26 সেপ্টেম্বর 1931: "নৈনি তালে শিল্প প্রদর্শনী - পোস্টারগুলি প্রশংসিত; ভারতীয় জীবনের মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনা"
- টাইমস অফ ইন্ডিয়া, 28 ফেব্রুয়ারি 1952: "সুকুমার বোসের ওয়ান-ম্যান শো, জেনারেল কারিয়াপ্পা দ্বারা উদ্বোধন"
- দ্য এজ (মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া), 25 নভেম্বর 1952: "ভারতীয় শিল্প"
- SukumarBose.org
- ↑ "Honour for city-born artist at World Book Fair"। The Times of India। ২০১৫-০২-০৭। আইএসএসএন 0971-8257। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৯-২২।
- ↑ "Modern Indian Art"। https://www.presidentofindia.gov.in। সংগ্রহের তারিখ ২৩ সেপ্টে ২০২৪।
|website=
এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য) - ↑ উদ্ধৃতি ত্রুটি:
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়;:0
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি - ↑ The Bombay Chronicle, Sunday 16 September 1934: "Sukumar Bose, Versatile Artist"
- ↑ পুরুষোত্তোমন, ভেঙ্কা (২০১৪)। দ্য আর্ট অফ সুকুমার বোস: রিফ্লেকশনস্ অন সাউথ অ্যান্ড সাউথ-ইষ্ট এশিয়া (ইংরাজী ভাষায়)। ইন্সটিটিউট অফ সাউথ-ইষ্ট এশিয়ান স্টাডিজ, সিঙ্গাপুর। পৃষ্ঠা ২৩৪। আইএসবিএন 978-98-1451-784-3।