ফুরফুরা দরবার শরীফ
ফুরফুরা দরবার শরিফ বা সিলসিলা-ই-ফুরফুরা শরীফ বা ফুরফুরা মাজার শরীফ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার একটি ইসলাম ধর্মীয় দরবার শরীফ ও আত্ন্যাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সাধারণ শ্রুতি রয়েছে, এটি রাজস্থানের আজমির শরীফের পরেই দেশের দ্বিতীয় সবচেয়ে সন্মানিত ও উল্লেখযোগ্য মাজার।[১] এই মাজারটি হুগলি জেলার শ্রীরামপুর মহকুমার জাঙ্গিপাড়া সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের ফুরফুরা গ্রামে অবস্থিত। এই মাজার শরীফটি উপমহাদেশের মুসলিমদের নিকট পবিত্র ও সন্মানিত স্থান।[২] ইসালে সওয়াব মাহফিলের সময়ে এটি প্রচুর সংখ্যক ধার্মিক মানুষদের আকৃষ্ট করে।[৩] এখানে কোন প্রকার শিরিক বেদআত হয় না।
ফুরফুরা দরবার শরীফ | |
---|---|
ধর্ম | |
অন্তর্ভুক্তি | সুন্নি ইসলাম |
জেলা | হুগলি জেলা |
প্রদেশ | পশ্চিমবঙ্গ |
যাজকীয় বা সাংগঠনিক অবস্থা | মাজার, দরবার শরীফ |
মালিকানা | পীরের বংশধর |
অবস্থান | |
অবস্থান | ফুরফুরা গ্রাম, শ্রীরামপুর মহকুমা |
দেশ | ভারত |
স্থানাঙ্ক | ২২°৪৫′১৬″ উত্তর ৮৮°০৭′৪৮″ পূর্ব / ২২.৭৫৪৫° উত্তর ৮৮.১৩০১° পূর্ব |
স্থাপত্য | |
স্থপতি | সুন্নি-আল-জামাত |
ধরন | মসজিদ, সুফি দরগাহ |
স্থাপত্য শৈলী | আধুনিক |
প্রতিষ্ঠার তারিখ | আনু. ১৯০০ সাল |
বিনির্দেশ | |
সম্মুখভাগের দিক | পশ্চিম |
গম্বুজসমূহ | ১ |
মিনার | ৬ |
ওয়েবসাইট | |
www |
১৯৬১ সালে হুগলি জেলার হাত বই (ইংরেজি: Hooghly district hand book) ও ১৯৭২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গ জেলা গ্যাজেটে (ইংরেজি: West Bengal district gazetters; Hooghly) অমিয় কুমার বাগচী মুসলিমদের তীর্থস্থান নামে অভিহিত করেছ।[৪][৫]
ইতিহাস
সম্পাদনা১৩৭৫ সালে মুকলিশ খানের নির্মিত মসজিদ কেন্দ্র করে এই দরবার শরীফের যাত্রা শুরু হয়।[৬] মৌখিক রীতি অনুসারে ১৩৫০ সালের দিকে বাগদি (বার্গা ক্ষত্রিয়) রাজা এখানে রাজত্ব করত। রাজত্বকালে শাহ কবির হালিবি ও করমুদ্দিন নামে দুই মুসলিম সৈন্য এই ক্ষত্রিয় রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পরাজিত করে, উভয় দলনেতাই যুদ্ধে নিহত হয়েছিল।[৭] তাদের সমাধি হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নিকট খুব পবিত্র হিসেবে বিবেচিত।[৮]
মূল ব্যক্তিত্ব
সম্পাদনাফুরফুরা গ্রামের অস্তিত্ব বহু পূর্ব থেকে থাকলেও এই দরবার প্রতিষ্ঠা করেন পীর আবু বকর সিদ্দিকী, তিনিই মূলত তিনি সিলসিলা-ই-ফুরফুরা শরীফের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁকে হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ বলা হয়। আনুমানিক ১৯০০ সালের দিকে এই দরবার প্রতিষ্ঠা হয়। বর্তমানে এই দরবার শরীফের মূল ব্যক্তিত্ব হচ্ছে পীর আবু বকর সিদ্দিকী ও তার পাঁচ ছেলে। তারা হল:
- পীর আবু বকর সিদ্দিকী (পিতা)[৯]
- আবদুল হাই সিদ্দিকী
- আল্লামা আবু জাফর সিদ্দিকী
- আবদুল কাদের সিদ্দিকী
- নাজমুস সায়াদাত সিদ্দিকী ও
- জুলফিকার আলী সিদ্দিকী
পিতা ব্যতীত পাঁচ ছেলে পাঁচ হুজুর কেবলা নামে পরিচিত। ইনারা সবাই তার পিতার খেলাফত পেয়েছিলো, এবং পীর ছিলেন। ইনারা দুই বাংলার বিভিন্ন স্থানে গমন করে ইসলাম প্রচার করেছেন এবং সাধারণ জনতাকে মুরিদ বানিয়েছেন ও দীক্ষা দিয়েছেন।
খলিফা
সম্পাদনামুজাদ্দিদে যামান আবু বকর সিদ্দীক উনার পাঁচ আওলাদ ব্যতীত উল্লেখযোগ্য অন্যান্য খলিফা হচ্ছেন
- রুহুল আমিন বশিরহাটি
- পীর আলহাজ্ব ছালামত উল্যাহ(বাগাদী, চাঁদপুর)
- নিছার উদ্দিন আহমদ (ছরছিনা)
- সূফী ছদর উদ্দিন
- প্রফেসর আব্দুল খালেক
- সুফী হাবীবুর রহমান (ভোলা)
- ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
- মৌলভী আব্দুল গফুর (চাঁদপুর,হাইমচর)
- সুফি আব্দুল মোমেন
- আরও
অন্তর্ভুক্ত দরবার সমুহ
সম্পাদনাফুরফুরা শরীফের খলিফাদের মাধ্যমে অনেক দরবার শরীফ ও খানকা প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের পশ্চিম বঙ্গের ও বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অধিকাংশ দরবার শরীফ-ই এই ছিলছিলার অন্তর্ভুক্ত। যেমন, পশ্চিম মেদেনি বাগ দরবার শরীফ বাংলাদেশের বাগদাদী দরবার শরীফ চাঁদপুর। ছরছিনা দরবার শরীফ, হক্বের দা'ওয়াত সিদ্দীকিয়া দরবার শরীফ, ছতুরা শরীফ, ফরায়েজিকান্দি দরবার শরীফ, ছালাম-আবাদ দরবার শরীফ, মাগুরা সিদ্দিকিয়া দরবার, ভান্ডারিয়া দরবার শরীফ ইত্যাদি।
অবদান
সম্পাদনাপীর আবু বকর সিদ্দিকী ছিলেন একজন সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারক, তাকে মোজাদ্দেদ জামান বা যুগের সমাজ সংস্কারক বলা হয়। তিনি দাতব্য প্রতিষ্ঠান, এতিমখানা, চিকিৎসা কেন্দ্র, মাদ্রাসা, বিদ্যালয় ও শিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি নারী শিক্ষায় অবদান রেখেছিলেন। তিনি সিদ্দিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে ফুরফুরা শরীফে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সিদ্দিকী সামাজিক অপরাধ দূর করার লক্ষ্যে বহু সামাজিক কর্মকাণ্ডের সা জড়িত সাথে জড়িত ছিলেন, এসব কাজের মধ্যেই সমস্ত জীবন ব্যয় করেছেন।
আবু বকর সিদ্দিকী একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ছিলেন, ফুরফুরা শরিফের মাদ্রাসা দরিদ্র ছাত্রদের তিনি বিনা মূল্যে বা অতি সামান্য মূল্যে বোর্ডিং সুবিধা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। তিনি অনেক ইসলামি পত্রিকা এবং সংবাদপত্রের পৃষ্ঠপোষকতাও করেছেন, পত্রিকাগুলোর মধ্যে সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা মুসলিম হিতৈষি অন্যতম। তার পরবর্তী পীর সন্তানেরা এসকল কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছিলেন। এছাড়াও আবু বকর একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন, তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করতে সক্রিয় ছিলেন। তার ভক্তের পরিধি পশ্চিম বঙ্গ, বিহার আসাম, ও বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) জুড়ে ওঅছিলো, এসব একালায় মুসলিমদের বাইরেও তার ভক্ত ছিলো। তার এবং তার পরবর্তী পীরসমূহের কার্যক্রম বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী ও আলেম কর্তৃক প্রশংসিত হয়ে থাকে।
পীরের তৈরিকৃত মাদ্রাসা একসময় পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বিদ্যাকেন্দ্রে পরিণত হয়, পূর্ববঙ্গের প্রসিদ্ধ ফরায়েজী আন্দোলনের প্রবর্তক হাজী শরীয়তুল্লাহ ফুরফুরাতে এসে আরবি ও ফার্সী ভাষা শিক্ষাগ্রহণ করেন।[১০][১১]
উরসের মেলা
সম্পাদনাএই দরবারের সব কার্যক্রমের মধ্যে উরসের মেলা সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণীয় বিষয়। এই মেলায় লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে থাকে, মেলাটি ফুরফুরা শরীফের মেলা বা দাদাপীরের উরস উৎসবের মেলা নামে পরিচিত।[১২] তবে আবু বকর সিদ্দিকী এই ধর্মীয় সমাগমের নাম দিয়েছিলো ঈসালে সাওয়াব। প্রতিবছর বাংলা বর্ষপঞ্জির ফালগুন মাসের ২১, ২২ ও ২৩ তারিখে (ইংরেজি মার্চ মাসের ৫, ৬ ও ৭ তারিখ) এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়।[১৩][১৪] বর্তমানে এই মেলা মূল পীরের নাতনীরা আয়োজন করে থাকে।
এই সময় মেলায় মুরিদান গানের শিক্ষা চলে, মেলায় খেলাফত প্রাপ্ত আলেমগণ মুরিদদের দাদাপীরের সিলসিলা মতে ইসলামি জ্ঞানের দীক্ষা দান করেন। ফুরফুরা শরীফের মসজিদ প্রাঙ্গণে সন্ধ্যায় একসাথে কয়েক লক্ষ মানুষের উপস্থিতি হয়। উৎসবের দিনে পীরের মূল মাজার ও মেলার দেড়-মাইল দূর থেকে মানুষজনের ভিড় শুরু হয়। বিভিন্ন ধরনের দোকান, খাদ্যসামগ্রী, মাথার নক্সাদার টুপি, তসবী, চা-পান-মিষ্টির বাজার বসে।[১২] এই মেলা গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ hindu, the (১৭ জানুয়ারি ২০২১)। "The Hindu e-Paper Today: ePaper replica of the print newspaper"। epaper.thehindu.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০১-১৮।
- ↑ "ফুরফুরা শরিফ - Vikaspedia Domains"। vikaspedia.in। ১৪ মে ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-১৪।
- ↑ "West Bengal Tourism Policy, 2008"। Fairs and Festivals Tourism। Government of West Bengal, Department of Tourism। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯।
- ↑ শ্রী সুধীর কুমার মিত্র (১৯৯১)। হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ। ৭৮/১ মহাত্মা গান্ধী রোড, কোলকাতা: মন্ডল বুক হাউস। পৃষ্ঠা ১৩০১।
- ↑ সৈয়দ মোঃ বাহাউদ্দিন (২০১৭)। যুগ প্রবর্তক শাহ আবু বকর সিদ্দিকী। আরামবাগ, হুগলি: সৈয়দ মোহাম্মদ হামযাহ। পৃষ্ঠা ২।
- ↑ "Hooghly District"। Places of Interest। District administration। ২০০৯-০২-০২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০২-০৬।
- ↑ Crawford, D. G. (অক্টোবর ২০০৮)। A Brief History of the Hughli District By D. G. Crawford। আইএসবিএন 9781443766128। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০২-০৬।
- ↑ Crawford, D. G. (অক্টোবর ২০০৮)। A Brief History of the Hughli District By D. G. Crawford। আইএসবিএন 9781443766128। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০২-০৬।
- ↑ দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী (২০১২)। "সিদ্দিকী, আবদুল হাই"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ ডঃ এম, এ রহিম (১৯৯৪)। বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস। ঢাকা, বাংলাদেশ: আহমদ পাবলিশিং হাউস। পৃষ্ঠা ৭৪।
- ↑ ডঃ অমলেন্দু দে (১৯৯১)। বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ। কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ। পৃষ্ঠা ৪৬।
- ↑ ক খ ব্রহ্ম, তৃপ্তি (১৯৮৮)। বাংলার লৌকিক ধর্মসংগীত। কলকাতা। পৃষ্ঠা ৩৬২।
- ↑ Qadri, M. Aqib Farid। "Conveying Rewards to the Deceased (Isaale Sawaab)"। Islamic Academy। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৫-১২।
- ↑ "Dariapur Sharif's Isale Sawab on Jan 17"। Financial Express, 14 January 2008। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৫-১২।