ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধান
ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধান হলো বাংলা ব্যাকরণের একটি বিশেষ নিয়ম৷ বাংলা ভাষার তৎসম শব্দে দন্ত্য-ন এর ব্যবহার না হয়ে মূর্ধন্য-ণ তে পরিবর্তনের নিয়মসমূহকে ণত্ব বিধান এবং দন্ত্য-স এর মূর্ধন্য-ষ তে পরিবর্তনের নিয়মসমূহকে ষত্ব বিধান বলা হয়৷[১]
ণত্ব বিধান
বাংলা বানানে ‘দন্ত্য-ন’ ও ‘মূর্ধন্য-ণ’ ব্যবহারের নিয়মকে ‘ণত্ব বিধান’ বলে৷ বাংলা ভাষায় সাধারণত মূর্ধন্য-ণ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই৷ সেজন্য বাংলা (দেশি), তদ্ভব, বিদেশি, বানানে মূর্ধন্য বর্ণ (ণ) লেখার প্রয়োজন হয় না৷ কিন্তু বাংলায় বহু তৎসম বা সংস্কৃত শব্দে মূর্ধন্য-ণ এবং দন্ত্য-ন এর ব্যবহার আছে। তা বাংলায় অবিকৃতভাবে রক্ষিত হয়৷ তৎসম শব্দের বানানে ণ এর সঠিক ব্যবহারের নিয়মই ণত্ব বিধান৷
ণ ব্যবহারের নিয়ম
- ঋ, র (্র), রেফ (র্), ষ (ক্ষ) বর্ণের পরে দন্ত্য-ন না হয়ে মূর্ধন্য-ণ হয়৷ যেমন: ঋণ, তৃণ, বর্ণ, বিষ্ণু, বরণ, ঘৃণা৷
- যদি ঋ, র (্র), ষ (ক্ষ) বর্ণের পরে স্বরবর্ণ, ক-বর্গ, প-বর্গ, য, ব, হ, য় অথবা অনুস্বার (ং) থাকে, তার পরবর্তী দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয়ে যায়। যেমন: কৃপণ, নির্বাণ, গ্রহণ৷
- ট-বর্গের পূর্বের দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয়৷ যেমন: বণ্টন, লুণ্ঠন, খণ্ড।
- প্র, পরা, পরি, নির্- উপসর্গের এবং ‘অন্তর’ শব্দের পরে নদ্, নম্, নশ্, নহ্, নী, নুদ্, অন্, হন্- কয়েকটি ধাতুর দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ নয়। যেমন: প্রণাম, পরিণাম, প্রণাশ, পরিণতি, নির্ণয় ইত্যাদি৷
- প্র, পরা প্রভৃতির পর ‘নি’ উপসর্গের দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয়৷ যেমন: প্রণিপাত, প্রণিধান ইত্যাদি৷
- কতকগুলো শব্দে স্বভাবতই মূর্ধন্য-ণ হয়৷ যেমন:
চাণক্য মাণিক্য গণ বাণিজ্য লবণ মণ
বেণু বীণা কঙ্কণ কণিকা৷
কল্যাণ শোণিত মণি স্থাণু গুণ পুণ্য বেণী
ফণী অণু বিপণি গণিকা৷
আপণ লাবণ্য বাণী নিপুণ ভণিতা পাণি
গৌণ কোণ ভাণ পণ শাণ৷
চিক্কণ নিক্কণ তূণ কফণি (কনুই) বণিক গুণ
গণনা পিণাক পণ্য বাণ৷
চাণক্য, মাণিক্য, কণা, গৌণ, নিপুণ, বাণিজ্য, লবণ, পণ্য, পুণ্য, বণিক, মণ, শোণিত, বিপণী, পণ, বীণা, বাণ, লাবণ্য, কণিকা, মণি, শাণ প্রভৃতি৷
কোথায় কোথায় ণত্ব বিধান নিষেধ বা খাটে না
- ত-বর্গযুক্ত দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয় না৷ যেমন: বৃন্ত, বৃন্দ, গ্রন্থ৷
- বাংলা ক্রিয়াপদের অন্তঃস্থিত দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয় না৷ যেমন: ধরেন, মারেন, করেন, যাবেন, খাবেন, হবেন, নিবেন, দিবেন৷
- বিদেশী শব্দের দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয় না৷ যেমন: কোরআন, জার্মান, জবান, নিশান, ফরমান, রিপন৷
- পূর্বপদে ঋ, র, ষ থাকলে পরপদে দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয় না৷ যেমন: মৃগনাভি, দুর্নাম, ত্রিনেত্র, মৃন্ময়৷
ষত্ব বিধান
যেসব তৎসম শব্দে ‘ষ’ রয়েছে তা বাংলায় অবিকৃত আছে৷ তৎসম শব্দের বানানে ষ এর সঠিক ব্যবহারের নিয়মই ষত্ব বিধান৷
ষ ব্যবহারের নিয়ম
- ঋ-কারে পরে মূর্ধন্য-ষ হয়৷ যেমন: ঋষি, বৃষ, বৃষ্টি৷
- অ, আ, বাদে অন্য স্বরবর্ণ, ক এবং র বর্ণের পরের প্রত্যয়াদির দন্ত্য-স মূর্ধন্য-ষ হয়৷ যেমন: ভবিষ্যৎ, পরিষ্কার, মুমূর্ষ ও মুমূর্ষু৷
- 'অতি', 'অভি' এমন শব্দের শেষে ই-কার উপসর্গ এবং ‘অনু’ আর ‘সু’ উপসর্গের পরে কতগুলো ধাতুর দন্ত্য-স এর মূর্ধন্য-ষ হয়৷ যেমন: অতিষ্ঠ, অনুষ্ঠান, নিষেধ, অভিষেক, বিষণ্ন (‘ণ্ন’ মূর্ধ-ণ পরে দন্ত্য-ন), সুষম৷
- নিঃ, দুঃ, বহিঃ, আবিঃ, চতুঃ, প্রাদুঃ এ শব্দগুলোর পর ক্, খ্, প্, ফ্ থাকলে বিসর্গ (ঃ) এর জায়গায় মূর্ধন্য-ষ হয়৷ যেমন: নিঃ কাম > নিষ্কাম, দুঃ কর > দুষ্কর, বহিঃ কার > বহিষ্কার, নিঃ পাপ > নিষ্পাপ৷
- কিছু শব্দ স্বভাবতই মূর্ধন্য-ষ হয়৷ যেমন: আষাঢ়, নিষ্কর, পাষাণ, ষোড়শ ইত্যাদি৷
- কতগুলো শব্দ বিশেষ নিয়মে মূর্ধন্য-ষ হয়৷ যেমন: সুষুপ্তি, বিষম, বিষয়, দুর্বিষহ, যুধিষ্ঠির ইত্যাদি৷
কোথায় কোথায় ষত্ব বিধান নিষেধ বা খাটে না
- সাৎ প্রত্যয়ের দন্ত্য-স এর মূর্ধন্য-ষ হয় না৷ যেমন:
- ভূমিসাৎ, ধূলিসাৎ, অকস্মাৎ৷
- খাঁটি বাংলা ও বিদেশী শব্দে মূর্ধন্য-ষ হয় না৷ যেমন:
- টেক্স, পুলিশ, জিনিস, মিসর, গ্রিস, স্টেশন, মুসাবিদা৷
- অঃ বা আঃ থাকলে তার পরে ক্, খ্, প্, ফ্ সন্ধিযুক্ত হলে বিসর্গ (ঃ) এর জায়গায় দন্ত্য-স হয়৷ যেমন:
- পুরঃ কার = পুরস্কার,ভাঃ কর = ভাস্কর, তিরঃ কার = তিরস্কার, পরঃ পর= পরস্পর, স্বতঃ ফূর্ত= স্বতঃস্ফূর্ত
- অঃ বা আঃ থাকলে তার পরে ক্, খ্, প্, ফ্ ছাড়াও ত থাকলেও স হতে পারে [তথ্যসূত্র প্রয়োজন], যেমন:
- মনঃ তাপ = মনস্তাপ, শিরঃ ত্রাণ= শিরস্ত্রাণ
ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধান-এর প্রয়োজনীয়তা
বাংলা ভাষার যে সব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে নেওয়া হয়েছে সে সব শব্দে সংস্কৃত ভাষার বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে৷ সংস্কৃত ভাষার বানান ও উচ্চারণরীতি ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত৷ সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিতেরা কোনো শব্দের উচ্চারণকে অনায়াস করার জন্য একটি শব্দে পরপর দুইটি ধ্বনিকে কাছাকাছি উচ্চারণস্থলের রাখার চেষ্টা করেছেন৷ মূর্ধন্য-ণ এবং দন্ত্য-ন-এর উচ্চারণ আপাতশ্রবণে কাছাকাছি মনে হলেও মূর্ধন্য-ণ উচ্চারণ করতে হয় মূর্ধা থেকে আর দন্ত্য-ন উচ্চারণ করতে হয় দন্ত থেকে৷ তাই, যে সব ধ্বনি উচ্চারণ করতে জিহ্বার অগ্রভাগ দাঁতকে স্পর্শ করে অর্থাৎ ‘ত’-বর্গীয় ধ্বনিগুলো (যেমন ত, থ, দ, ধ) উচ্চারণ করার সময় কাছাকাছি আরেকটি ধ্বনি মূর্ধা থেকে উচ্চারণ না করে দন্ত থেকে উচ্চারণ করা সহজসাধ্য৷ সেকারণে সাধারণভাবে ‘ত’-বর্গীয় ধ্বনির সাথে যুক্ত ধ্বনি দন্ত্য-ন হয়৷ একই নিয়ম অনুসারে, যেসব ধ্বনি উচ্চারণ করতে জিহবার অগ্রভাগ মূর্ধাকে স্পর্শ করে অর্থাৎ ‘ট’-বর্গীয় ধ্বনিগুলো (যেমন ট, ঠ, ড, ঢ)-র সাথে যুক্ত ধ্বনি মূর্ধন্য-ণ হয়৷ ঋ, র, ষ উচ্চারণ করতে হয় মূর্ধা থেকে আর তাই এই ধ্বনিগুলোর সাথে যুক্ত ধ্বনি হয় মূর্ধন্য-ণ৷ এখানে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ্য যে, “বণ্টন, লুণ্ঠন”-এই শব্দগুলোর প্রথম মূর্ধন্য-ণ টি ‘ট’-বর্গীয় ধ্বনির সাথে যুক্ত হয়ে উচ্চারিত হচ্ছে, তাই এখানে ণত্ব বিধান ব্যবহৃত হবে, কিন্তু পরের দন্ত্য-ন এর আগে বিরতি থাকায় মূর্ধন্য-ণ হচ্ছে না৷ ষত্ব বিধান-এর জন্যও একই রকম নিয়ম প্রযোজ্য৷
তথ্যসূত্র
- ↑ বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড